রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ প্রবৃদ্ধির জন্য হুমকি

রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য হুমকি। বিশ্বব্যাংকের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ কথা বলেছেন। বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মি. বসু বলেন, চলতি অর্থবছর থেকে ২০১৬’র জুন মাসের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬.৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। আগামী অর্থবছরে তা ৬.৭ শতাংশ হতে পারে। এমনকি বাংলাদেশ যদি তাদের কিছু অর্থনৈতিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক ইস্যু এবং জঙ্গিবাদ কার্যকরভাবে ও সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারে তাহলে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তিনি আরও বলেন, অনেক দেশে রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ এক্ষেত্রে আলাদা নয়। কিন্তু এসব সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড দিয়ে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ গত বছর জুড়ে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উত্তেজনার ভুক্তভোগী। একই বছর সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে প্রচারণা শুরু করেছে সহিংস জঙ্গিরা। ৪ জন ধর্মনিরপেক্ষ লেখক ও একজন প্রকাশককে হত্যা করেছে তারা। হত্যা করেছে বাংলাদেশে কর্মরত দুই বিদেশিকে। একজন জাপানি, অপরজন ইতালিয়ান। নিহত একজন ব্লগার ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। আইএস দুই বিদেশি কর্মীকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। কিন্তু দেশে তাদের অস্তিত্বের বিষয়টি অস্বীকার করেছে সরকার। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশে রাজনৈতিক জঙ্গিবাদ স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। মি. কৌশিক বসু এ বিষয়টিকে উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের উচিত বিষয়টিকে খতিয়ে দেখা। কেননা, এটা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। তিনি অবকাঠামোর নানাখাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের পরামর্শ দেন। বিশেষ করে জ্বালানি, বন্দর ও যোগাযোগ খাতের ওপর জোর দেন তিনি। কেননা, এটা বাংলাদেশের বর্তমান ২৫০০ কোটি ডলারের তৈরী পোশাক রপ্তানিকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে। বর্তমানে বাংলাদেশ অবকাঠামো খাতে ৩০০ কোটি ডলার ব্যয় করে। দেশটির উন্নয়ন অংশীদারদের মতে এ খাতে ব্যয় করা উচিত ১২০০ কোটি ডলার। ব্যবসার ব্যয় কমাতে মি. বসু আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণেরও পরামর্শ দেন।
স্থিতিশীল অর্থনীতির প্রধান দুই চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীলতার জন্য প্রধান দুইটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু। প্রথমটি হচ্ছে অবকাঠামোগত সমস্যা। অন্যটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। গতকাল তিন দিনের সফর শেষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই চ্যালেঞ্জের কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এ সময় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্টিন রামা, ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পালসহ উভয় প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ড. কৌশিক বসু বলেন, বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। আরও এগিয়ে যাবে। পোশাক শিল্প কারখানা ঘুরে দেখেছি। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মানোন্নত হয়েছে বেশকিছু কারখানার। তবে সব যে উন্নত তা বলবো না। যে সব কারখানার উন্নয়ন হয়েছে সেগুলো অনুকরণীয়। অনুন্নত কারখানা দেশের উন্নত কারখানাকে অনুসরণ করতে পারে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগে বাধা বলে মনে করেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে আরও স্থিতিশীলতা দরকার। এর জন্য সরকারের পাশাপাশি দেশের মানুষকেও ভাবতে হবে। পদ্মা সেতু সংক্রান্ত এক প্রশ্নোত্তরে ড. কৌশিক বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প হাতে নেয়ায় বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণ পেয়েছে। এখন থেকে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ অংশীদারের ভিত্তিতে কাজ করতে পারবে। দেশের অর্থনীতি বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ও দেশের অর্থনীতি বিশ্লেষকদের বৈপরীত্যের প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কৌশিক বসু বলেন, সমালোচনা হওয়া ভালো। কিন্তু আন্দাজে না করে পরিসংখ্যান দেখে বলা উচিত। যানজটও উন্নয়নে বাধা বলে মনে করেন তিনি। অর্থপাচার ও দুর্নীতি বিষয়ে কৌশিক বলেন, অর্থপাচার ও  দুর্নীতি থামানো কঠিন। পৃথিবীর অনেক জায়গায় হচ্ছে। তবে সরকারকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।
কৌশিক বসু বলেন, গত ৫ বছর ধরে ৬ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। এই প্রবৃদ্ধিতে ধনী-গরিব সবারই অবদান আছে। কৌশিক বসু বলেন, দেড় দশকে বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পেরেছে। তিনি বলেন, একটি দেশের সরকার দরিদ্র মানুষের কাছে যদি খাবার পৌঁছাতে যায় তবে সেখানে অনেক গ্যাপ থেকে যায়; অনেক খাবারের অপচয় হয়। সেখানে খাবার না দিয়ে যদি গরিব ও প্রান্তিক মানুষগুলোর কাছে টাকা পৌঁছানো যায় অর্থাৎ মানুষগুলোকে আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায় তবে অনেক লাভ হয়। কারণ তাদের হাতে যখন টাকা থাকবে তখন তাদের নিজস্ব পছন্দ প্রাধান্য পাবে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তারা পছন্দমত জায়গায় তা ব্যয় করতে পারবে। আর তাদের চাহিদা মেটাতে অনেক নতুন নতুন বেসরকারি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ঠিক এ সময়টাতেই সেদেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসবে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশে গরিব ও প্রান্তিক মানুষগুলোকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে সম্পৃক্ত করতে বেশকিছু কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক গরিব মানুষকে আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে; যা উল্লেখ করার মতো। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও মোবাইল ব্যাংকিং। এগুলোর কারণে মানুষের টাকার ব্যবহার বেড়েছে ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ড. কৌশিক বসু বলেন, দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসা বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় অর্জন। বাংলাদেশই শিখিয়েছে দরিদ্রতা, প্রতিবন্ধকতার পরও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ঝুঁকি নিয়ে কিভাবে কার্যক্রম শুরু করতে হয়। এসব বিষয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনুসরণীয় উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি শিক্ষণীয় কিভাবে তারা দারিদ্র্য দূর করছে এবং মানুষকে আর্থিক খাতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি পুরোপুরি প্রস্তুত ‘টেক অফ’ করার জন্য। খুব কম দেশই রয়েছে যাদের অর্থনীতি এভাবে উঠতে পারে।
কৌশিক বসু বলেন, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সুসমন্বয় ছাড়া এটির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, তবে সমন্বিত উন্নয়নের অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের আগেই বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ এমনকি অতিক্রমও করেছে। ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও বড় মাপের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পথে পা বাড়াতে বাংলাদেশ প্রস্তুত উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের প্রধান এ অর্থনীতিবিদ তা বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি সুসমন্বয়ের পরামর্শ দেন। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মনে করেন, গরিব মানুষের কথা চিন্তা করে বিশ্বব্যাংক উন্নয়নের সমবণ্টনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও জরুরি। অর্থনীতির উদীয়মান তারকা, বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কও নতুন মাত্রা পাবে বলে মনে করেন তিনি। একই সঙ্গে আর্থিক বিশৃঙ্খলা মোকাবিলায় বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের বিচক্ষণতার প্রশংসা করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বিগত ১০ বছর ধরেই ৬-এর ঘরে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি এবার ৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছবে। আতিউর রহমান বলেন, কেবল প্রবৃদ্ধি বাড়া নয়, বিশ্বমন্দার নেতিবাচক প্রভাব থেকেও মুক্ত থেকেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতাকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন অতিমাত্রায় জরুরি বলেও জানান তিনি। ড. আতিউর রহমান বলেন, বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ একটি চমকপ্রদ জায়গা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদেশিরা এখানে সস্তা শ্রমে উৎপাদনমুখী খাত, অবকাঠামোগত খাত, শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে পারে। তিনি বলেন, যারা টাকা নিয়ে ফেরত দেয়ার অভ্যাস নেই তাদের জন্য সুদের হার কমানো হবে না।

No comments

Powered by Blogger.