অভিবাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কিনিরা by ইব্রাহীম চৌধুরী

জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস-ভীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন মার্কিনিরা। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত তাঁরা। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে আসা প্রায় দুই কোটি অবৈধ অভিবাসীর ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকারে। চলমান অভিবাসন-প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দরজা ক্রমশ সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের অধিকাংশই হিস্পানিক। নানা কৌশলে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া এসব হিস্পানিক অভিবাসীকে নিয়ে অভিযোগের কোনো অন্ত নেই। স্বল্প মজুরির কাজকর্ম এখন তাঁদের দখলে। সাধারণ মার্কিনিদের মতে, এসব অভিবাসীর কারণেই মজুরির বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। হিস্পানিক অবৈধরা লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালায়, এতে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অপরাধ জগতে জড়িয়ে থাকা লোকজনের মধ্যেও হিস্পানিক অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে এখন সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে অভিবাসনের যোগসূত্র খোঁজা হচ্ছে।
২০০০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কাজের জন্য মুসলমান অভিবাসীদের প্রতি সন্দেহ জোরালো হয়ে ওঠে। গত ১৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত লোকজনের অভিবাসী এবং মুসলমান পরিচয়টি আলোচনায় চলে আসে। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়াতে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত মুসলিম দম্পতির অভিবাসন পরিচয় নিয়ে মার্কিন মিডিয়া এখনো সরগরম।
যুক্তরাষ্ট্রের লোকজন এখন নিজেদের নিরাপত্তার সঙ্গে অভিবাসন নীতিকে জড়িয়ে চিন্তা করছেন। এর প্রভাব পড়েছে রাজনীতিতে। রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারের শুরুতেই বলেছিলেন, হিস্পানিকরা জাত অপরাধী, এদের প্রবেশ ঠেকাতে হবে। তিনি মেক্সিকো সীমান্তে বেষ্টনী দেওয়ারও প্রস্তাব করেছেন। এর মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ায় হত্যাকাণ্ডের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলমানদের জন্য অভিবাসন সাময়িকভাবে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এসব অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে অভিবাসন নিয়ে চলমান চিন্তার প্রতিফলন বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও প্রকাশ্যে এসব বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বলা হচ্ছে , ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য মার্কিন অভিবাসন চেতনারপরিপন্থী।
টেক্সাসের বেকার ইনস্টিটিউটের রাজনীতিবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ মার্ক জোন্স বলেছেন, মার্কিনিদের বেশির ভাগ মানুষের চলমান চিন্তাধারার কথাটি বেরিয়ে এসেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের গত কয়েক দশকের জরিপে দেখা গেছে, এ দেশের অধিকাংশ মানুষই ছিল অভিবাসনের পক্ষে। এমনকি রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত রিপাবলিকান সমর্থকদের মধ্যেও অভিবাসনের প্রতি সহায়ক ভূমিকা ছিল লক্ষণীয়। রিপাবলিকান দলের ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসার স্বার্থে বাইরে থেকে অদক্ষ শ্রমিক আনার পক্ষে ছিল। এ গ্রুপটিকে তাদের ব্যবসার জন্য, প্রতিষ্ঠানের জন্য নানা ধরনের ভিসায় দক্ষ-অদক্ষ কর্মী বাইরের দেশ থেকে আনার জন্য সব সময় সক্রিয় দেখা যেত। পাশাপাশি ডেমোক্র্যাট দলটি অভিবাসনবান্ধব হিসেবে পরিচিত। অভিবাসী ভোটারদের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য, পারিবারিক অভিবাসনকে সহজ করাসহ অবৈধদের বৈধতা দেওয়ার জন্য ডেমোক্র্যাট দলের তৎপরতা সব সময়ই ছিল ইতিবাচক।
গত ৫০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকা থেকে অভিবাসন ঘটেছে ব্যাপকভাবে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ অভিবাসী ছিল ৮৪ শতাংশ। এখন এ সংখ্যা ৬২ শতাংশে নেমে এসেছে। অভিবাসনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অশ্বেতাঙ্গরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। আমেরিকার আধুনিক অভিবাসন জোয়ারে গত ৫০ বছরে ছয় কোটি মানুষের আগমন ঘটেছে। অভিবাসনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছরে আমেরিকায় আরও ১০ কোটিরও বেশি মানুষের আগমন ঘটবে বলে পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি অফ ল-এর পরিচালক মুজাফফর চিশতী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ম-বর্ণের মিশ্র অভিবাসন গত ৫০ বছরে বদলে গেছে অপ্রত্যাশিতভাবে। তিনি বলেন, ‘আমেরিকার নীতিনির্ধারকদের ধারণা ছিল পূর্বসূরিদের হাত ধরে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় ব্যাপক পারিবারিক অভিবাসন ঘটবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক উত্থান ঘটলে ইউরোপের লোকজনের আমেরিকায় আসায় ভাটা পড়ে। পারিবারিক অভিবাসনে এখন এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকা থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিবাসীর আগমন ঘটে থাকে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে আসা লোকজনের সংখ্যাও বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। ছাত্র ভিসায় আসা বা সাময়িক কাজের জন্য আসা লোকজনের থেকে যাওয়া একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

No comments

Powered by Blogger.