সিলেটে বর্বরতা সুমির দমবন্ধ ১৫ দিন

‘ও নির্দয়ের মতো আমাকে লোহার রড দিয়ে পেটাতো। ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে শরীরের গোপন অংশসহ সবখানে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্ত বের করে দিতো। ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঁচড় দিতো। ব্যথায় কাতরালে শরীরে প্যাথিড্রিন ইনজেকশন দিতো। এভাবে টানা ১৫ দিন আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে শামীম।’ সিলেটে স্বামীর নির্যাতন থেকে উদ্ধার হওয়া গৃহবধূ সৈয়দ জেরিন আক্তার সুমি ও তার স্বজনরা মানবজমিনের কাছে বর্বর নির্যাতনের বিবরণ দেন এভাবে। সুমি এখন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। কথা বলতে গেলেই জড়িয়ে যায়। আর নির্যাতনের কথা বলতে গেলে শিউরে ওঠেন। বলেন, লোহার রড দিয়ে পেটাতো। লোহার শিকল দিয়ে নির্বিচারে আঘাত করতো। সুঁই ঢুকিয়ে দিতো নখের ডগায়। যখন যন্ত্রণায় ছটফট করতাম তখন স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ফার্মাসিস্ট এনে প্যাথিড্রিন দিতো। প্রায় ১৫ দিন অভুক্ত থাকার পর যখন তাকে পুলিশ উদ্ধার করে তখন মরণপ্রায় অবস্থা। জ্ঞান থাকলেও কথা বলার শক্তি ছিল না। হাসপাতালে নিয়ে টানা ১২ ঘণ্টা চিকিৎসা দেয়ার পর এখন কিছুটা কথা বলতে পারছেন সুমি। মঙ্গলবার ইসলামপুরের ৭৫/এ গার্ডেন ভিউ বাসার ফ্ল্যাট থেকে সুমিকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় আটক করা হয় স্বামী শামীম খানকে। আর এ ঘটনায় রাতেই সুমি বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় নির্যাতনকারী স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছে শাহপরাণ থানা পুলিশ। ১১ বছর আগে ইসলামপুর এলাকার শামীম খানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো জকিগঞ্জের সুমির। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের দাবিতে সুমির ওপর নির্যাতন শুরু করে শামীম। নির্যাতন এড়াতে সুমিকে প্যাথিড্রিন ইনজেকশন দিতো শামীম। তাতেই ক্ষান্ত না হয়ে সর্বশেষ স্ত্রীর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে ছুরিকাঘাত করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাতো সে। সুমির পরিবারের লোকজন জানান, বিয়ের পর কিছুদিন ভাল কাটলেও এরপর থেকেই সুমির ওপর শুরু হয় নির্যাতন। বিয়ের বছর পূর্ণ হতে না হতেই কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে সন্তান। তার নাম রাখা হয় তাহনু আক্তার। এভাবে কাটতে থাকে সুমির জীবন। তাহনুর জন্মের তিন বছর পর আরও একটি সন্তান আসে সুমির ঘরে। তার নাম রাখা হয় তাকিব। দুটি সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েই ১১ বছর ধরে মুখ বুজে সংসার করছেন সৈয়দা জেরিন আক্তার সুমি। কিছু দিন ধরে স্বামীর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। স্বামী শামীম খান নির্যাতন ঢাকতে স্ত্রী সুমিকে প্যাথিড্রিন ইনজেকশন দিতে শুরু করে। তাতেই ক্ষান্ত হয়নি শামীম। সর্বশেষ স্ত্রীকে ছুরিকাঘাত করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। তাহনু ও তাকিব মাকে নির্যাতন না করার জন্য বাবার কাছে আবদার করে। কিন্তু ক্ষুব্ধ শামীম সন্তানদের সামনেই সুমিকে ছুরিকাঘাত করে বলে স্থানীয় লোকজন জানান। সুমির ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে শামীমের বৃদ্ধ মা ফোন দিয়ে সুমিকে যেকোন উপায়ে উদ্ধার করার জন্য জানান। সুমির শাশুড়ির ফোন পেয়ে পরিবারের লোকজন পুলিশ নিয়ে গিয়ে উদ্ধার করে তাকে। এ সময় সুমি অজ্ঞান ছিলেন। তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। তার গায়ে ছিল একাধিক ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। ঘরে পাওয়া যায় প্যাথিড্রিন ইনজেকশনের খালি বোতল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে পাঠানো হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বর্তমানে সুমি হাসপাতালের ৪র্থ তলার ৬ নং ওয়ার্ডে চিকিসাধীন। নির্যাতিত সুমির পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১১ বছর আগে শহরতলীর মেজরটিলা ৭৫-এ ইসলামপুর এলাকার শামীম খানের সঙ্গে বিয়ে হয় জকিগঞ্জ উপজেলার ৯ নং মানিকপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের সৈয়দ মঈন উদ্দিনের মেয়ে সুমির। মাসখানেক আগে সুমিকে মারধর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় শামীম। পরে সুমির মা ও অন্যদের কাছে শামীম মাফ চাইলে সবাই তাকে ক্ষমা করে সুমিকে তার হাতে তুলে দেন। এরপর থেকেই তার ওপর নতুন মাত্রায় শুরু হয় নির্যাতন। প্রায়ই সুমির ওপর প্যাথিড্রিন ইনজেকশন পুশ করা হতো বলে পরিবারের লোকজন জানান। সুমির মা আলেয়া বেগম বলেন, বড় কষ্ট করে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। সাধ্যমতো সব দিয়েছি। তাকে এমন নির্যাতন চালানো হয়েছে আমি তার শাস্তি চাই। মহানগর পুলিশের শাহপরাণ থানার ওসি নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, স্ত্রীকে নির্যাতনের ঘটনায় শামীমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.