যেমন আছ তেমনি এসো by উম্মে মুসলিমা

আলজেরিয়ান এক সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, একজন আলজেরিয়ান বর তাঁর নতুন বউয়ের বিরুদ্ধে ‘মানসিক শান্তিভঙ্গে’র অভিযোগে আদালতে ২০ হাজার ডলারের মামলা করেছিলেন। কারণ কী? না, তিনি বাসররাত শেষে সকালে উঠে বউকে চিনতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন কোনো চোর ঢুকেছে তাঁর বাসায়। সংবাদে আরও বলা হয়, বিয়ের দিন তিনি বউটিকে প্রসাধনচর্চিত যে রূপে দেখেছিলেন, পরদিন সে রকম তাঁকে পাননি। তাই প্রতারণার অভিযোগে তাঁর ওই মামলা। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, আলজেরিয়ার নারীরা এখনো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত এবং বেশির ভাগ বিয়েই মা-বাবার সম্মতিতে হয়। এমনকি নারীরা অভিভাবক বা স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে বাইরে চাকরি করতে পারেন না। এটা দুঃখজনক হলেও সত্য যে যেসব নারী বাইরে বেরোন, তাঁদের খুব কমই প্রসাধনহীন দেখা যায়।
আমেরিকার প্রখ্যাত গায়িকা-নায়িকা বিয়ন্স প্রসাধনহীন হয়ে বিবাহবার্ষিকী উদ্যাপন করে মিডিয়াজগতে ঝড় তোলেন। তিনি নারীদের প্রসাধনহীন হয়ে বিয়ে করতে অনুপ্রেরণা দেন। ক্যারোলিন মার্কে, যিনি কোনো মেকআপ ছাড়াই বিয়ে করেছিলেন, তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণত প্রসাধন করি না। তাই বিয়েতেও সেটা করিনি, যাতে কারও আমাকে চিনতে কষ্ট হয়। এ রকম একটি বিশেষ দিনে আমার চামড়া অপেক্ষাও আরও গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার বিষয় ছিল।’
আমেরিকার ফ্যাশন ম্যাগাজিন ইনস্টাইল-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন নারী তাঁর সারা জীবনে গড়ে ১২ লাখ টাকা শুধু প্রসাধনসামগ্রীতে ব্যয় করেন। আমাদের এ গরিব দেশেও মেয়েরা এ ক্ষেত্রে খরচ করেন। একটা ভালো বিউটি পারলারে শুধু বিয়ের দিনের মেকআপে খরচ ১৫ হাজার বা তার বেশি। হলুদ, বিয়ে, সংবর্ধনার প্যাকেজ প্রায় অর্ধলাখ টাকা। অনেকেই লক্ষ করে থাকবেন, কনে কখনোই সঠিক সময়ে অনুষ্ঠানে হাজির হতে পারেন না। কারণ, পারলারেও সিরিয়াল থাকে। রাতে বিয়ের অনুষ্ঠান হলে দুপুরের আগে গিয়ে পারলারে বসে থাকতে হয়। তারপর যখন সেখান থেকে তিনি বের হন, তখন তাঁকে চেনার কোনো উপায় থাকে না। মনে হয় এক বালতি গোলানো চুনের মধ্যে মাথার চুল ধরে তাঁকে কপাল অবধি চুবিয়ে তোলা হয়েছে। তাঁর আসল গায়ের রং বের করতে হলে ঝিনুক দিয়ে চাঁছা লাগবে। মুখের চেয়ে মুখোশই যেখানে পরিচয়ের বাহন। এক বিয়ের কনেকে মঞ্চে বসে থাকতে দেখেছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন প্রাণহীন পিতলের মূর্তি। অল্প দুঃখে রবীন্দ্রনাথ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ’?
নারীর বেলায় ফরসা রংই যোগ্যতা। সেই সঙ্গে লম্বা ও ছিপছিপে হলে সোনায় সোহাগা। কিন্তু পুরুষের যোগ্যতা তাঁর গায়ের রং বা চেহারায় নয় নিজেকে সুন্দর দেখাতে কে না চায়? কিন্তু তার মানে কি নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা? আমি যা নই, তা প্রকাশ করায় কৃতিত্ব কোথায়? এ যেন অনেকটা স্বরচিত রবীন্দ্রসংগীত। বিয়েতে পুরুষেরা কি এ রকম সাজেন? তাঁরা বড়জোর একটু ফেসিয়াল সেরে চুলটুল সেট করে আসেন। কনেকে কেন একবেলার জন্য অন্য কেউ হতে হবে? এ তো আর কিছুই নয়, সেই চিরকালীন ফরসা রঙের কাছে নতজানু হওয়া। ভারতের নন্দিত তারকা নন্দিতা দাশ ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ বা ‘কালোই সুন্দর’ নামে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। তিনি বলেন, তাঁর কালো রঙের কারণে চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাঁকে গরিব ও নিম্নশ্রেণির নারীর ভূমিকায় অভিনয়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এমনকি ধনী চরিত্রে অভিনয়ের প্রয়োজনে তাঁকে তাঁর চামড়ার রং পরিবর্তনেরও উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন যে একবার নিজেদের জিজ্ঞেস করুন তো শুধু ফরসাই কি একমাত্র মানদণ্ড, যা আমাদের সুন্দর করে? কখনোই কালো বলে নিজেকে অসুন্দর ভাববেন না, তাহলে আপনার আশপাশের মানুষও তা-ই ভাববে। কারণ, কালো হওয়া বা ভারতীয় হওয়া আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী হয়নি। কালো ধনীরা গায়ের চামড়া পরিবর্তন করে বা অনেক দামি প্রসাধনসামগ্রী মেখে ‘ফরসা সুন্দরী’ হতে পারেন, কিন্তু আপামর কালো মেয়েরা সস্তা প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহার করে চিরকালের জন্য ত্বকের দফারফা করে ফেলছেন এবং মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পতিত হচ্ছেন।
শুধু নারীকে ফরসা বানিয়ে আর গালিগালাজ খেতে রাজি নন পুঁজিপুরুষেরা। তাই পুরুষের জন্যও রং ফরসাকারী ক্রিম বাজারে ছেড়েছেন। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পুঁজি-বাণিজ্য। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ব্যবসার প্রধান লক্ষ্য মুনাফার জন্য পুঁজি বিনিয়োগ। পুঁজির কর্তারা জানেন কোথায় বিনিয়োগ করলে তাঁদের বাজার রমরমা হবে। পুরুষবাদী সমাজ বলে দিয়েছে, ফরসা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ‘স্নো হোয়াইট’ না হতে পারলে রাজপুত্র এসে উদ্ধার করবে না। ফরসা সুন্দরী না হলে যতই তাঁর পায়ের মাপে কাচের জুতো খাপে খাপ হোক, রাজার ছেলে সে রকম সিনডারেলা চাইবে না। তাই আমরা আমাদের গায়ের রং ফরসা করতে চাই আর সুচতুর পুঁজিবাদীরা বিশ্বব্যাপী রং সাদা করার ক্রিম বিক্রি করে মুনাফা লুটতে চায়।
আমাদের সমাজে সাধারণভাবে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকারের উদাহরণ কোনটি? নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি কালো মেয়ে। প্রথমত, তিনি পুঁজিবাদী সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার, পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার এবং শেষ পর্যন্ত বর্ণবৈষম্যের শিকার। নারীর বেলায় ফরসা রংই যোগ্যতা। সেই সঙ্গে লম্বা ও ছিপছিপে হলে সোনায় সোহাগা। কিন্তু পুরুষের যোগ্যতা তাঁর গায়ের রং বা চেহারায় নয়। তিনি কালো, মোটা, টেকো, বেঁটে—যা-ই হন না কেন, তিনি কতটা উচ্চশিক্ষিত ও ধনী, সেটাই তাঁর যোগ্যতার মাপকাঠি। অনেক সময় উচ্চশিক্ষাও পয়সার কাছে হার মানে। তাই শিক্ষিত-সচেতন-আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীদের নিজের প্রকৃত চেহারাকে ভালোবাসতে হবে।
নারীরা ঘরে-বাইরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেধা ও শ্রম দিয়ে স্বনির্ভরতা অর্জন করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন। তাঁরা সুঠাম শারীরিক কাঠামো, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বক আর সুন্দর পোশাকে নিজেকে চৌকস ও কর্মক্ষম রাখবেন। মেধার চর্চায় অবয়বে ফুটিয়ে তুলবেন বুদ্ধিদীপ্ত। সাদা কাদা মেখে তা আড়াল করাই হবে বোকামি। এতে প্রকৃত সৌন্দর্যপ্রিয় পুরুষেরাও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করবেন। নারী-পুরুষ একে অন্যের কাছে মুখোশহীন হয়ে উপস্থিত হবেন, তা যেমন হবে প্রসাধনীমুক্ত, একই সঙ্গে সব ধরনের প্রতারণামুক্ত।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক ও জেন্ডার সমতাবাদী লেখক।
muslima.umme@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.