মালয়েশিয়ার বাজার নিয়ে গোষ্ঠীর সঙ্গে বায়রার লড়াই by শরিফুল হাসান

সরকারিভাবে (জিটুজি) জনশক্তি রপ্তানি ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে বেসরকারিভাবে আগামী তিন বছরে ১৫ লাখ কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে মালয়েশিয়া। কিন্তু এই লোক পাঠানোর প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দুই পক্ষের মধ্যে ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’ শুরু হয়েছে। দুই পক্ষেই আছেন মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ী, সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী এবং প্রভাবশালীরা।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) নেতারা অভিযোগ করেছেন, ১০-১২ জনের একটি গোষ্ঠী চাইছে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু সাধারণ ব্যবসায়ীরা চান, সবার জন্য উন্মুক্ত থাকুক।
দুই পক্ষের এই ‘লড়াইয়ে’ কর্মীদের খরচ বৃদ্ধির এবং প্রতারণার আশঙ্কা করছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা। এদিকে নতুনভাবে কর্মী নেওয়ার আগে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন কারণে অবৈধ হয়ে পড়া প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি বৈধতা চাইছেন।
বেসরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানির প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলতে আজ শনিবার রাতে ঢাকার উদ্দেশে কুয়ালালামপুর ছাড়বে মালয়েশিয়ার একটি প্রতিনিধিদল। দলটির নেতৃত্ব দেবেন ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক মুস্তফা বিন ইব্রাহিম। তবে দলে শ্রম বা মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কেউ নেই। প্রতিনিধিদল রোববার প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বায়রা এবং ১১ আগস্ট প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবে। জানা গেছে, এই সফরে কোনো চুক্তি হবে না।
জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকে অনেক প্রস্তাব দিচ্ছেন। তবে আমি কোনো খারাপ প্রস্তাব বা খারাপ লোককে আমার আশপাশে ভিড়তে দেব না। প্রতিনিধিদল আসছে। আমিও চাই মালয়েশিয়ার বাজার চালু হোক। তবে এমনভাবে আমরা সব করব, যাতে একজন কর্মীও যেন প্রতারিত না হয়, কম খরচে গিয়ে মালয়েশিয়ায় কাজ পায়। এ ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাকেই খরচ বহন করতে হবে। আর রিক্রুটিং এজেন্সির ভূমিকা কী হবে, সেটাও আমরা নির্ধারণ করব।’
বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম বাজার মালয়েশিয়া ২০০৯ সালে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়। ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর সরকারিভাবে কর্মী পাঠাতে দুই দেশ চুক্তি করে। এরপর মালয়েশিয়া পাঁচ বছরে পাঁচ লাখ লোক নেওয়ার আশ্বাস দিলে সারা দেশে সাড়ে ১৪ লাখ লোক নাম নিবন্ধন করেন। কিন্তু মালয়েশিয়া চাহিদাপত্র না পাঠানোয় গত আড়াই বছরে মাত্র আট হাজার কর্মী গেছেন। অথচ এই সময়ে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রফেশনাল ভিসায় বিপুলসংখ্যক শ্রমিক নিয়েছে। সাগরপথে অবৈধভাবে গিয়েও অনেকে কাজ পেয়েছে। কিন্তু গত মে মাসে থাইল্যান্ডে এবং পরে মালয়েশিয়ায় গণকবর পাওয়ার পর বিশ্বজুড়ে এই মানব পাচার নিয়ে সমালোচনা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে আবারও বাংলাদেশ থেকে বেসরকারিভাবে কর্মী নেওয়ার প্রস্তাব দেয় মালয়েশিয়া। ওই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ২৩ জুন তৎকালীন প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন মালয়েশিয়ায় যান। ২৪ জুন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ জাহিদ হামিদির সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। পরে জাহিদি ১৫ লাখ কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দেন।
এরপরই নতুন করে লোক আনার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে নিতে দুটি পক্ষ তৎপর হয়ে ওঠে। একটির নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মালয়েশীয় নাগরিক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমিন বিন আবদুল নূর। বায়রার অভিযোগ, তাঁর সঙ্গে রয়েছে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালসহ ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান। এরা কয়েকবার সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করে। মালয়েশিয়ার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজমি খালিদ, শ্রম বিভাগের সাবেক পরিচালক টেংকু ওমরসহ আরও কয়েকজন প্রভাবশালী এই পক্ষে আছেন।
বায়রা বলেছে, মোহাম্মদ আমিনের প্রতিষ্ঠান বেসটিনেট এবং মালয়েশিয়ান ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফডব্লিউসিএমএস) বিরুদ্ধে এই বছর নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ট্রাভেল পারমিট দেওয়ার কাজ পাওয়ার পর মালয়েশিয়া থেকে একজন বাংলাদেশির দেশে ফিরতে চার গুণ বেশি খরচ হচ্ছে।
অন্যদিকে প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণে নিতে বায়রা মালয়েশীয় নাগরিক আরেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী আবু হানিফকে তাঁদের বৈদেশিক প্রতিনিধি মনোনীত করে। হানিফের সঙ্গে মালয়েশিয়ার একজন মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠতা আছে। হানিফের প্রতিষ্ঠান রিয়াল নেটে স্বরাষ্ট্র অধিদপ্তরের (কেডিএন) সাবেক মহাপরিচালক রাজা আজহার বিন আবদুল মানাফ ও একজন মন্ত্রীর কয়েকজন আত্মীয় পরিচালক হিসেবে আছেন। হানিফ ২৫ জুন বায়রার সভাপতি আবুল বাসার, মহাসচিব মনসুর আহমেদ কালাম ও জ্যেষ্ঠ সভাপতি আলী হায়দারকে নিয়ে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বদল হওয়ায় কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে মোহাম্মদ আমিন পক্ষ। অন্যদিকে হামিদি মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী হওয়ায় অপর পক্ষের অবস্থান শক্ত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাতে আবু হানিফের নেতৃত্বে রিয়েল নেটের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছে। দলের সদস্যরা আজ (শনিবার) দুপুরে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে তাঁদের ওয়ার্ক ফোর্স ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড মনিটরিং সিস্টেমের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করবে। এর আগে বুধবার মোহাম্মদ আমিন, ক্যাথারসিসের মালিক রুহুল আমিনসহ কয়েকজন প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন।
রুহুল আমিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই কম খরচে লোকজন মালয়েশিয়া যাক। এ কারণে বেসটিনেটের এফডব্লিউসিএমএস প্রস্তাব নতুন মন্ত্রীকে বলেছি। আমরা মালয়েশিয়ার নতুন উপপ্রধানমন্ত্রীর একটি ধন্যবাদ চিঠিও তাঁকে পৌঁছে দিয়েছি। বায়রার সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু আমরা শুনেছি, বায়রা মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ৫০ হাজার লোক পাঠানোর অনুমতি চেয়েছে। তারা কীভাবে লোক পাঠানোর অনুমতি চায়?’
তবে বায়রার সভাপতি আবুল বাসার বলেন, ‘আমরা মালয়েশিয়ার বাজার খুলতে এত দিন চেষ্টা করছি। আমরা দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। আমরা চাই, সবাই ব্যবসা করবে। কিন্তু আমিনরা সিন্ডিকেট করে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। আমরা তা হতে দেব না। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীও বলেছেন, কোনো সিন্ডিকেট হবে না।’
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন কারাম এশিয়ার আঞ্চলিক সমন্বয়ক হারুন আল রশিদ বলেন, ‘এর আগে যতবার মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়েছে, ততবারই দুই দেশের একটি চক্র দুর্নীতিতে জড়িয়েছে। এবারও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মাঠে নেমেছেন। লোক আনার কাজ শ্রম ও মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হলেও স্বরাষ্ট্রের আগ্রহই বেশি। বাংলাদেশের এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত।’
এদিকে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন কর্মী আনার আগে অবৈধ শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ায় অবৈধ হয়ে পড়া প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি এখন চরম আতঙ্কে আছেন। কুয়ালালামপুরে নোয়াখালীর গোলাম রাব্বানী, চাঁদপুরের শাহজালাল, নরসিংদীর জাহাঙ্গীর আলম ও মুন্সিগঞ্জের শহীদ হোসেনসহ আরও অনেকে জানান, মালয়েশিয়ার যদি সত্যিই কর্মী লাগে, তাহলে নতুন কর্মী আনার বাণিজ্য না করে চার লাখ অবৈধকে বৈধ করুক।
তবে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এ মুহূর্তে চাইলেও অবৈধদের বৈধ করার নতুন প্রস্তাব বাংলাদেশ দিতে পারে না। তবে একবারেই সব লোককে ফেরত পাঠানো হবে না। নতুনরা আসবেন, অবৈধরা ফেরত যাবেন।’ নতুন কর্মী আনার প্রক্রিয়া কী হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, লোকজন যেন প্রতারিত না হন।’

No comments

Powered by Blogger.