চিহ্ন মুছে যাচ্ছে বজরার শাহী মসজিদের by নাসিরউদ্দিন বাদল

বজরার শাহী মসজিদ হারিয়ে যাচ্ছে। কোন একসময় হাজারও পর্যটকের দেখা মিলতো এ বজরায়। প্রতিদিন পর্যটকরা দেখতে আসতেন শাহী মসজিদ। কিন্তু আজ তা আর নেই। পর্যটকও নেই। শাহী মসজিদের ঐতিহ্যও নেই। এ মসজিদ স্থাপিত হয়েছিল ১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে। সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা শাহী জামে মসজিদ দিল্লির জামে মসজিদের অনুকরণে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুবাহদার ইসলাম খাঁ নোয়াখালীর ভুলুয়া বিজয় করেন। তবে এর আগে ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালীর ভুলুয়া দ্বীপ অঞ্চলে কিছু সংখ্যক মুসলমান ধর্মীয় যোদ্ধা সুফি সাধকের আগমন ঘটে যার আবরণে বজরা নামক নৌযানে করে সমুদ্র পথে দিল্লি থেকে বর্তমান বজরা নামক স্থানে আগমন করেন। সেখানে বালু স্তরে তাদের নৌকা আটকে গেলে ওখানে নৌযান নৌঙর করে তারা প্রথম নামাজ পড়েন। সেই স্থানেই পরে বজরা শাহী মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাদের বজরা নৌযানের নামেই বজরা নামকরণ করা হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সেই মুসলিম ধর্মীয় যোদ্ধা ও সুফি সাধকদের মধ্যে মিয়া অম্বর শাহের ব্যক্তিত্ব নেতৃত্ব ধর্মীয় একাগ্র ত্যাগ নিষ্ঠা সাহসিকতা সততা, ন্যায়নীতি ও মানব প্রেমে অভিভূত হয়ে বজরা অঞ্চলে ওমরাবাদ পরগণায় (পূর্বে দাদরা ওমরাবাদ) ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটায়। ওমরাবাদ জমিদার পরিবারের সন্তান জমিদার আমান উল্যা খান ছোটবেলায় পরিবারের পক্ষ থেকে দিল্লি দেওবন্দ মাদরাসা শিক্ষা শেষে দেশে ফিরে নিজ পরগনার জমিদার বাড়ির দরজার সামনে প্রায় ১৬ একর ভূমির উপর মগ সমপ্রদায় দিয়ে একটি বিশাল দীঘি খনন করান। দীঘির পশ্চিম-দক্ষিণ সুউচ্চ পাড়ে ১১৫৪ হিজরি, বাংলা ১১৩৯ বঙ্গাব্দ, ১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল প্রতিষ্ঠিত ভারতের দিল্লি শাহী জামে মসজিদের হুবহু অনুকরণে বজরা শাহী জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০ ফুট মাটির নিচ থেকে গাঁথুনি দিয়ে সম্পূর্ণ চুন সুরকিতে তৈরি সুদৃশ্য তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের দৈর্ঘ্য ১১৬ ফুট প্রস্থ ৭৪ ফুট এবং উচ্চতা মাটির উপর থেকে ২০ ফুট। এর বিশেষত্ব হচ্ছে প্রথম প্রবেশ পথে একটি স্বাগত গেট। অভ্যন্তরের প্রবেশ দ্বারে আরেকটি আকর্ষণীয় তোরণ। এর ভেতরে চারদিক ওয়াল ঘেরা মাঝখানে ফাঁকা। এর এক পাশে শায়িত আছেন জমিদার আমান উল্যা ও ভ্রাতা ছানাউল্যা এবং মহীয়সী মাতা বিবি মরিয়ম জমিদার। মসজিদের ভেতরে ঢোকার জন্য ৩টি সুদৃশ্য ধনুকাকৃতির প্রবেশ পথ। সামনে পূর্ব দিকে বিশাল খোলা প্রাঙ্গণ অদূরে দীঘির পাড়ে বিশাল পাকা ঘাটলা এবং মসজিদের দক্ষিণ পাশে খালি জায়গায় রয়েছে জমিদার বংশের পারিবারিক কবরস্থান। বজরা শাহী জামে মসজিদের প্রধান আকর্ষণ হলো এই মসজিদ ভবনের ছাদ, পার্শ্ব পাদদেশ বাইরে এবং ভিতরে আকর্ষণীয় মূল্যবান মার্বেল পাথরে আচ্ছাদিত এবং নানান কারুকাজ আরবি ফারসি লেখনিতে প্রস্তর শিলালিপি খচিত। দীর্ঘ দিন থেকে এই মসজিদে শিরনিসহ নানা দান-মানত দিতে অনেকে আসতো। মুসলিম ধর্মীয় পরিবারে রোগমুক্তি শান্তি সমৃদ্ধির উদ্দেশে হাজার হাজার দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ভিড় করতো এখানে। বজরা শাহী মসজিদের পশ্চিমে অবস্থিত ওমরাবাদ পরগনার জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ির দরজার সেই ঐতিহাসিক কাচারি ঘর যা আজও স্থানীয় বজরা ইউনিয়নের তহসিল অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তহসিল অফিসের পশ্চিম পাশেই রয়েছে জমিদারদের বাড়ির অতি পুরনো একটি ভঙ্গুর টয়লেট। তহসিল অফিসের সাবেক কর্মকর্তা মাস্টার আবদুর রাজ্জাক (৮০) জানান, প্রয়াত জমিদার আমান উল্যা, ছামান উল্যা মোট জমিদারি ১০ আনা এবং নবাব ফয়েজের নেছা ৬ আনা মালিক ছিলেন। বাড়ির আয়তন ছিল ৫ একর। বৃটিশ আমলে জমিদারি হস্তান্তর হলে তারা কুমিল্লা থেকে জমিদারি খাজনা আদায় করতে আসতেন এখানে। ১৯৫৩ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে ১৯৫৬ সালের দিকে স্থায়ীভাবে ওমরাবাদ পরগনার জমিদারগণ কুমিল্লায় চলে যান। কুমিল্লায় নবাব ফয়েজুন্নেছা কলেজ, (দক্ষিণ চরতা মুন্সি বাড়ি ও সাহাব বাড়ি গালস স্কুল, ওমরাবাদ বংশের জমিদাদেরই প্রতিষ্ঠিত বলে জানান তিনি। বজরা শাহী জামে মসজিদের সম্মুখস্থ দীঘির উত্তর পাড়ে মুসলিম ধর্মীয় সুফি সাধক মিয়াম্বর শাহের মাঝার রয়েছে। মাঝারের পাশে বর্তমানে মারকাযুল উলুম মিয়াম্বর কাওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া ও বর্তমান সোনাইমুড়ী উপজেলার অম্বরনগর গ্রাম খানি মিয়া অম্বর শাহের নামে নামকরণ করা হয়েছে। মিয়াশ্বর শাহের মাঝারের দায়িত্বে আছেন সুফি নজীর আহম্মদ। মাদরাসার সুপার মুফতি মমিন উল্যার নিকট থেকে জানাযায় স্থানীয় নবাবগঞ্জ বাজার নবাবী আমলে জমিদারদের হাতে প্রতিষ্ঠিত এবং বর্তমান বজরা হাসপাতাল জমিদারদের জমিদারি ইজারা ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া নবাবগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশে সোনাইমুড়ী চৌমুহনী সড়কের পাশে অতি প্রাচীনতম নবাবগঞ্জ মসজিদটিও জমিদার পরিবারের লোকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলে তিনি জানান।

No comments

Powered by Blogger.