রাজনীতি এখন মরা নদীর নাম by পীর হাবিবুর রহমান

রাজনীতি এখন আর্দশহীন বন্ধা নদীর নাম। কি আওয়ামী লীগ, কি বিএনপি বা অন্যন্য রাজনৈতিক দল সবর্ত্র একই অবস্থা। পল্টন ও তোপখানা রোড থেকে এক সময় বামপন্থীদের যে রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠত সেটি এখন মরা খালে পরিণত। উপমহাদেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও বন্ধাত্ব এখন এতটাই প্রকট যে নতুন নেতৃত্ব বা আর্দশবান কর্মী সৃষ্টির উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে না। বারবার ক্ষমতায় আসা ও আগামী দিনের রাজনীতির স্বপ্ন দেখলেও বিএনপি নামের দলটিও এখন সাংগঠনিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু ধারায় পতিত। এখানেও নেতৃত্ব এবং কর্মী তৈরির পথটি রুদ্ধ। এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছোট ছোট দলগুলোও চরমভাবে নেতৃত্ব ও কর্মী সংকটে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। সামগ্রিক রাজনীতিতে গত তিন দশক থেকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের রাজনীতি নীতিহীন, মূল্যবোধহীন, ক্ষমতাকেন্দ্রীক, ভোগ বিলাসের পথ হাঁটতে হাঁটতে  আজকের এই মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। এককালে ছাত্র রাজনীতির সৃজনশীলতার পথহাটা গণতান্ত্রিক মূলবোধ ও দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্ভাসিত আর্দশবান তরুণেরা রাজনীতিতে আসতেন ত্যাগের মহিমায়। স্বাধীনতা পূর্ব ও উত্তর বাংলাদেশে এই ধারা খরস্রোতা নদীর মতো ছিল বহমান। একদিকে সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল রাজনীতিকে সেই তুর্কি তরুণরাই অগ্নিমুখুর করতেন। '৯০ উত্তর গণতন্ত্রের এই তিন দশকে সেই দৃশ্যপট হারিয়ে গেছে। এ দেশের রাজনীতিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে রেখে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে আর্দশ নির্ভর আলোকিত ছাত্র রাজনীতির নেতাকর্মীরা সমৃদ্ধ করেছেন। '৯০ উত্তর জমানায় সেই পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ডাকসুসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেয়ার মধ্য দিয়ে। আর এই কাজটি সচেতনভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকার যখন যারা ক্ষমতায় এবং তাদের আজ্ঞাবহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাতুরতার সঙ্গে করেছেন। এরমধ্য দিয়ে একসময় শিক্ষাঙ্গন থেকে জাতির সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত হয়ে মেধাবী সন্তানরা আর্দশের মহিমায় রাজনীতিতে আসতেন। কার্যত ছাত্র রাজনীতিই ছিল জাতীয় রাজনীতির নেতাকর্মী তৈরির আলোকিত প্রোডাকশন হাউজ। এই প্রোডাকশন হাউজ থেকে বেরিয়ে রাজনীতির প্রতি আগ্রহী তরুণরা আইন পেশায় যুক্ত হতেন। কেউবা জড়িয়ে যেতেন শিক্ষকতায়। গণমানুষকে সম্পৃক্ত করে নিজেদের ইমেজ তৈরির মাধ্যমে গণসংগঠনে রাখতেন ভূমিকা। নেতৃত্বের আলোয় বিকশিত হতেন মানুষের আস্থা ও ভালবাসায়। গত তিনদশক ধরে আইনজীবী ও শিক্ষকরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে নির্বাসিত হচ্ছেন। সেখানে রাজনীতিতে উড়ে এসে জুরে বসছেন মধ্যসত্বভোগী দালাল, ঠিকাদার ব্যবসায়ী গোষ্ঠি থেকে রাজনৈতিক ছায়ায় সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে মুনাফালোভী চক্র। এরাই রাজনীতিকে পেশিশক্তি, কালো টাকা নির্ভর আধিপত্য বিস্তারের পথে নিয়ে গেছে। এখানে সৃজনশীল, মেধাবী, সৎ ও ভদ্র আর্দশবান নেতাকর্মীরা অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাচ্ছেন। তারা এই দুবৃত্তায়নের রাজনীতি কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। আজকের জাতীয় রাজনীতিতে যেসব প্রবীণ নেতাদের মুখ ভাসছে তাদের রাজনৈতিক অতীত গৌরবের হলেও বর্তমান অন্তহীন দহনের পরিবর্তিত রাজনীতিতে তারাও জনগণের আর্দশ নির্ভর ঐতিহ্যের ধারা রক্ষার সংগ্রাম থেকে দূরে সরে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিকে আশ্রয়, প্রশয় দিচ্ছেন। এতে করে তাদের অতীত উজ্জ্বল বর্ণময় হলেও বর্তমান বর্ণহীন ধূসর। তিনদশক ধরেই রাজনীতিতে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য,লুটপাট সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। সুশাসন উপেক্ষিত হয়ে আসছে। ত্যাগের আর্দশের রাজনীতির কবর দেয়া হচ্ছে। সেই সব বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী নেতারা সমালোচনা সয়েও বেঁচে আছেন বলে যেন রাজনীতিতে আছেন। '৬০ এর দশকের হাত ধরে '৭০ অতিক্রম করে ছায়ায় ছায়ায় স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্মী তৈরি হয়েছিল তাদের অনেকেকেই নির্বাসনে যেতে হয়েছে।
সেই কালের ছাত্র রাজনীতি আর্দশের পথ হাঁটার কারণেই জাতীয় রাজনীতি হয়ে উঠেছিল গৌরবময়। গত তিনদশক ধরে আর্দশহীন ছাত্ররাজনীতি দিনে দিনে চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, দখল বাজির বিত্তবৈভবের লোভের পথ হেঁটে অতীতের ঐতিহ্যকে করেছে কলঙ্কিত। আর এখান থেকে জাতীয় রাজনীতিতে নেতাকর্মীর অভিষেক ঘটছে না। অনেকেই রাজনীতিজীবী হয়ে উঠছেন। একসময় মানুষের কল্যাণের জন্য ছিল রাজনীতি। সেই রাজনীতিতে টাকার খেলা ও সন্ত্রাস আর দুর্নীতির ঠাঁই ছিল না। একালের রাজনীতি রাতারাতি বিত্ত বৈভব বানিয়ে ক্ষমতার আধিপত্য রাখার লোভের পথ নিয়েছে বলে মানুষেরও শ্রদ্ধার জায়গা সরে যাচ্ছে। অথচ আমাদের আর্দশবান রাজনৈতিক নেতাকর্মীর আত্মদানের মধ্য দিয়ে লেখা হয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস। আমাদের রাজনীতির অতীত ঐতিহ্য কতটা বর্ণময় ও ত্যাগের সেটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ করলেই পাওয়া যায়। আমাদের অতীত রাজনীতির ইতিহাস '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে দীর্ঘ সংগ্রামের রক্তভেজা পথ হাঁটা উত্তাল সংগ্রামের। লাখো লাখো শহীদের রক্তগঙ্গা আর রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আর্দশের পথে অবিচল চলা জাতির জীবনে শ্রেষ্ঠ অর্জন এনে দিয়েছে। সেটি হচ্ছে ফাঁসির মঞ্চকে আলিঙ্গন করা বাঙ্গালী জাতির মহা নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভূদয়। আমাদের গণতন্ত্রের সংগ্রাম পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে বীরত্বের মাইলফলক গাঁথা। আমাদের সেইসব রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা হাঁসতে হাঁসতে কারাগারে দুঃসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতেন। দেশের মানুষ ও মাটির সঙ্গে অঙ্গীকার রক্ষার মাধ্যমে সততার ইতিহাসই রচনা করতেন নাম ছায়ায় ছায়ায় প্রজন্মকে ত্যাগের মহিমায় পথ হাঁটতে শেখাতেন। নিজেরা যেমন শ্রদ্ধা কুড়াতেন, মানুষের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে পথ চলতেন তেমনি তাদের অনুসারিদেরও সেভাবে তৈরি করতেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুই নন, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী, কৃষকের বন্ধু শেরেবাংলা একে ফজলুল হক রাজনীতি করতে গিয়ে দেশ প্রেমের বর্ণাঢ্য ইতিহাস রচনা করে গেছেন। মানুষের জন্য সারাটি জীবন কল্যাণের বার্তা নিয়ে ছুটেছেন। বিত্ত বৈভব আর বেসাত সম্পদের পাহাড় গড়ে যাননি। যারা তাদের দেখেনি, যারা তাদের র্স্পশ করেনি; তারাও শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতায় এখনও অবনত মস্তকে স্মরণ করেন। একালের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তাদের আর্দশের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করেন না। একালের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সিংহভাগ নিজেদের ক্ষমতা, ভোগ-বিলাস, অর্থবিত্ত বানাবার পথটি দেখেন। তাই রাজনীতি হারিয়েছে তার গৌরবের মুকুট। রাজনৈতিকদলগুলোতে দেখা দিয়েছে চরম বন্ধাত্ব। আর্দশবান তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি বিমুখ হয়ে উঠছে। তরুণ প্রজন্মের ভেতরে পরিবর্তনের প্রসব বেদনা চলছে। একালের ভোগবিলাসে মত্ত বেপোরোয়া রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা এই প্রজন্মের হৃদয়ের ভাষাও বুঝতে পারছেন না। রাজনীতিতে মেধাবী ও সৃজনশীল আর্দশবান সন্তানদের অভিষেক ঘটছে না বলে রক্তসঞ্চালন হচ্ছে না। উপর থেকে যাদের চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তারা তৃণমূলে গিয়ে অসুস্থ রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন সিন্ডিকেটের মুকুটহীন সম্রাট ভাবছে। রাজনীতির দীর্ঘ চর্চা অনুশীলনের ওরিয়েন্টেশন না থাকায় বিভেদ, তিক্ততা বাড়ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এই চলমান বন্ধা অসুস্থ রাজনীতির চর্চা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে মৌলবাদের উত্থান ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। রাজনীতিকে আর্দশ নির্ভর ত্যাগের পথেই ঢেলে সাজাবার সময় কড়া নাড়ছে।
ডাকসুসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত করা না গেলে, তৃণমূল জুড়ে দলীয়ভাবে গণতন্ত্রের চর্চা চালু না হলে রাজনীতি মরা নদীর মতোই অকার্যকর হয়ে পড়বে। নদী খননের মতো রাজনীতির মরা নদীতে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হলে তারুণ্যের জন্য রাজনীতির আর্দশের দুয়ার খুলে দিতে হবে। সংবিধান আইন অনুযায়ী গণতান্ত্রিক চেতনায় রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি দুর্নীতি, সন্ত্রাসের লাগাম টেনে ধরেই ছাত্র রাজনীতিকে সেই গৌরবময় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীত্বে শক্তিশালী করতে হবে। আর সেজন্য শতফুল ফুটতে দিতে হবে। মেধাবী সৃজনশীল জনপ্রিয় রাজনৈতিক কর্মী তৈরির জন্য ছাত্র সমাজের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়া সময়ের দাবি। অর্থাৎ ডাকসুসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজদের বিদায়ের মাধ্যমে আর্দশের পতাকাবাহী ছাত্রনেতাদের অভিষেক ঘটবে। এদের আগমনেই জাতীয় রাজনীতিতে ফিরে আসবে গুনগত পরিবর্তন। রাজনীতি ফিরে পাবে জোয়ার।

No comments

Powered by Blogger.