নারী যেখানে গুম হচ্ছেন প্রতিদিন

মেক্সিকোর এই দেয়ালচিত্রটি সে দেশে নারীর প্রতি সহিংসতারই প্রতিচ্ছবি
গুয়াদালুপ রেইস স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর ১৮ বছর বয়সী মেয়ে মারিয়ানা একদিন উড়োজাহাজ চালাবেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ১০ মাস আগে মেক্সিকোর কেন্দ্রস্থল থেকে গুম হয়েছেন ওই তরুণী। তাঁর আর দেখা নেই। কর্তৃপক্ষের ধারণা, তারা মারিয়ানার দেহাবশেষ পেয়েছে। পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতিতে ওই দেহাবশেষ একটি সাধারণ সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের এমন ভাষ্য মানতে নারাজ রেইস। অন্য অনেক মেক্সিকানের মতো তিনিও তাঁর নিখোঁজ প্রিয়জনের ঘরে ফেরার আশায় পথ চেয়ে আছেন।
কথিত মারিয়ানার দেহাবশেষ তুলে ডিএনএ পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে গত মাসে কর্তৃপক্ষকে রাজি করিয়েছেন রেইস। আবেগ জড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘তাঁর (মারিয়ানা) বেঁচে থাকা নিয়ে আমি আশা হারাইনি। এখন ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
কালো চুলের মেয়েটি গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর ঘরের বাইরে যান। বৈমানিক হওয়ার বৃত্তি পেতে কিছু কাগজপত্রের ফটোকপি করাতে গিয়েছিলেন তিনি। আর ঘরে ফেরেননি।
সম্প্রতি বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়, মেক্সিকোর জনবহুল মেক্সিকো রাজ্যে মারিয়ানার মতো মেয়ে ও নারীদের গুম হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। সেখানে এই প্রবণতা বেড়েই চলছে। অঞ্চলটি নারীদের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ন্যাশনাল ফেমিসাইড সিটিজেন অবজারভেটরির পরিচালক মারিয়া দে লা লুজ এস্ত্রাদা বলেন, এদোমেক্সে প্রতিদিন গড়ে দুজন করে নারী গুম হন।
মেক্সিকো রাজ্য এদোমেক্স নামেও পরিচিত। অঞ্চলটির মাঠে-ঘাটে, এমনকি নর্দমায় অহরহ মেলে ক্ষতবিক্ষত, অর্ধনগ্ন বা দগ্ধ লাশ।
দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, এদোমেক্সে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালে খুন হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে ১৪ জন নারী।
এদোমেক্সের জেন্ডার অপরাধবিষয়ক কৌঁসুলি দাইলসিয়া গার্সিয়া দাবি করেন, পারিবারিক সহিংসতা ও যৌন নিপীড়নের কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটে।
তবে জাস্টিস, হিউম্যান রাইটস ও জেন্ডার সংস্থার প্রেসিডেন্ট রদোলফো দমিনিগেজ বলেন, নৃশংস মাদক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই নরহত্যা ঘটছে। ওই মাদক যুদ্ধে ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। নিখোঁজ ২২ হাজার।
রদোলফো দমিনিগেজ বলেন, মেক্সিকোবাসী একটি সহিংস পরিবেশে বাস করে। এটা সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে সামরিক কৌশলের ফল। আর এটাই নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে শোচনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। গুরুদণ্ডের অভাবে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে।
সাংবাদিক হামবার্তো পেডগেট তাঁর ‘দ্য ডেড অব দ্য স্টেট’ বইয়ে লিখেছেন, ২০০৫ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে এদোমেক্সে এক হাজার ৯৯৭ জন নারী খুন হয়েছেন।
এদোমেক্সে খুনের এই ঘটনাগুলো এমন সময় ঘটেছে, যখন রাজ্যের গভর্নর ছিলেন এনরিকো পেনা নিতো। সেই তিনিই এখন দেশের প্রেসিডেন্ট।
রাজ্যটিতে নারীদের খুন হওয়ার বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান দেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে এদোমেক্সের জেন্ডার অপরাধবিষয়ক কৌঁসুলি গার্সিয়ার দাবি, বেসরকারি সংস্থাগুলো খুনের যে ভয়ংকর পরিসংখ্যান দিচ্ছে, সংখ্যাটা ততটা নয়।
এদোমেক্সে নারীদের খুন হওয়ার সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, বাস্তবতা হলো—সেখানে লাশ মিলছে, দীর্ঘ হচ্ছে সারি।
এদোমেক্সের পরিস্থিতি ভীতিকর। সেখানে অনেক নারী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। বাইরে গেলে তাঁদের ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা নেই। সেখানকার পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ, তা বোঝা যায় ১৭ বছর বয়সী আইদার কথায়। এই তরুণীর ভাষ্য, ‘আমরা কখনো একা থাকি না। যেখানেই যাই না কেন, আমরা দলবেঁধে যাওয়ার চেষ্টা করি।’

No comments

Powered by Blogger.