স্বপনের মৃত্যু by আনিসুল হক

কীটনাশকে লিচুবাগানগুলোর পাতা-কুড়ানিরা মারা
গেল কি গেল না, তাতে কীই-বা যায় আসে!
আমাদের অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিবেক হয় মৃত, নয়তো ঘুমন্ত। আমরা সাত চড়েও আর রা করব-টরব বলে মনে হয় না। নইলে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া ১২ শিশুর ১১ জনই মারা গেছে—এই খবরটা আরও অনেক খবরের ভিড়ে হারিয়ে যায়! এই খবরে কারও নিদ্রার সামান্য ব্যাঘাত ঘটে না! আমাদের দৈনন্দিনতার মসৃণ চাদরে সামান্য ভাঁজ পড়ে না, আমাদের নিস্তরঙ্গ পুকুরে ক্ষুদ্র একটা ঢিলও পড়ে না। ১১ জন শিশু মারা গেছে, এটা কোনো খবর নাকি!
ওরা তো মরবেই। ওরা যে প্রান্তিক শিশু। গ্রামের কৃষকের শিশু। তবে হ্যাঁ, একজন কিন্তু প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তিনি হলেন দিনাজপুরের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক, তিনি জানিয়েছেন, এই খবর স্রেফ গুজব। জেলায় লিচু খেয়ে কোনো শিশু মারা যায়নি।
এদিকে প্রথম আলোর দিনাজপুর প্রতিনিধি গেছেন দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে। হাসপাতাল সূত্রে তিনি জানাচ্ছেন, গত ২৯ মে থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত ওই হাসপাতালে অজ্ঞাত রোগে ১২ জন শিশু ভর্তি হয়েছিল। একজনকে তার অভিভাবকেরা রংপুর মেডিকেল কলেজে সরিয়ে নেন। বাকি ১১ জনই হাসপাতালে মারা যায়।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে হাসপাতালের চিকিৎসক বলেছেন, মৃত শিশুদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদের সবার বাড়ি লিচুবাগান-সংক্রান্ত এলাকায়।
প্রথম আলোর প্রতিবেদক দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার পাল্টাপুর ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর গ্রামে যান। মারা যাওয়া শিশু স্বপন আলীর মা সাবিনা খাতুন জানান, বাগানের মালিকেরা লিচুগাছে এমন বিষ দিয়েছিলেন যে গন্ধ সহ্য করা যাচ্ছিল না। পরদিন অন্য শিশুদের সঙ্গে তাঁর ছেলে স্বপনও বাগানে যায় লিচু কুড়াতে। সাবিনা খাতুন বলেন, ‘রাইতত খাইদাই ঘুমাইছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরয়াল খালি বিছানাত গড়াগড়ি খাছে। খিঁচুনি আর জ্বর। সকাল আটটার সমে জ্ঞান হারাইছে। বীরগঞ্জ হাসপাতালত ডাক্তার ভালো করে দেখি সঙ্গে সঙ্গে দিনাজপুর পাঠাইছে। ডাক্তাররা অক্সিজেন স্যালাইন লাগাইছে। কিন্তু ওই রাইতত মোর জাদু মারা গেইছে।’ (প্রথম আলো, ২৫ জুন, ২০১৫)
১১ জন শিশু শুধু হাসপাতালে মারা গেছে। তিন সপ্তাহের মধ্যে। কতজন হাসপাতাল পর্যন্ত যায়নি, তা অনুমান করলে শিউরে উঠতে হয়। অথচ এই খবরে কারও মধ্যে কোনো বিকার দেখি না।
অথচ হুবহু একই খবর ২০১২ সালেও প্রকাশিত হয়েছিল। সেবারও লিচুবাগানে কীটনাশক দেওয়া লিচু খেয়ে মারা গিয়েছিল শিশুরা। সেবারও সেই খবরের সত্যতা অস্বীকার করা হয়েছিল। এবং আমরা সবাই এ রকম কিছু আদপে ঘটেনি ভেবে পাশ ফিরে শুয়েছি। আমাদের বিবেককে জাগতে দিইনি, পাছে বিবেকের দংশনে আমাদের আরামে বিঘ্ন ঘটে।
গরিবের শিশু মারা গেলে কী? ঢাকা থেকে বহুদূরে দিনাজপুরের লিচুবাগানগুলোর পার্শ্ববর্তী পাতা-কুড়ানিরা মারা গেল কি গেল না, তাতে আমাদের কীই-বা যায় আসে!
শুধু ওই বাড়িগুলো শোকে স্তব্ধ। স্বপনের মা কাঁদেন। স্বপনের বাবা কাঁদেন। আর কাউকে বিলাপ করতে হবে না। কোনো পদক্ষেপ, কোনো উদ্যোগ আয়োজনেরও দরকার নেই।
কিন্তু যদি বলি, ওই লিচু ঢাকায় আসছে। ঘুষ হিসেবে, উপঢৌকন হিসেবে দিনাজপুরের লিচুর বড়ই কদর ঢাকায়। আপনার শিশু, আমার শিশুও ওই লিচু খাচ্ছে, খেয়েছে এবং খাবে। আপনিও খাবেন। আমিও খাব।
এইবার একটু গায়ে লাগবে। হায় হায়, আমার কিছু হবে না তো! আমার সন্তানের কিছু হবে না তো!
‘লিচুচোর’ আমাদের প্রিয় কবিতা। আমরা যে-কেউ লিচুবাগানের নিচে গেলে পড়ে থাকা লিচু মুখে দিতে পারি। বাজার থেকে কিনে এনেও তো লিচু খাই। সেই লিচুতে কী এমন বিষ দেওয়া হয় যে, কুড়িয়ে পাওয়া লিচু খেয়ে শিশুরা মারা যায়, প্রতিবছর। তাহলে কী করা যায়! একটা কিছু তো করাই উচিত!
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান এস এম ওয়ারেস বলেছেন, লিচু পাকার মৌসুমে কৃষি বিভাগের উচিত বাগানে কীটনাশক প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা। পাশাপাশি কীটনাশক প্রয়োগের পর বাগানে শিশুদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক প্রচারণা দরকার।
আসলে এই দেশটা যাচ্ছেতাই একটা দেশ। যাচ্ছেতাই কথাটা সচেতনভাবে বসিয়েছি, এর মানে যা ইচ্ছা তাই—যার যা খুশি তা-ই করতে পারে এখানে। লিচুবাগান আমার, আমি যতটা ইচ্ছা কীটনাশক প্রয়োগ করব, কার কী! তার কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃত প্রথা-পদ্ধতি আছে কি না, কোন কীটনাশক কত মাত্রায় কখন প্রয়োগ করা যাবে, আদৌ প্রয়োগ করা যাবে কি না, কে দেখবে?
সরকারের বিভাগ আছে। তারাই সবার আগে তদারক করবে, সেটা তো স্বাভাবিক চাওয়াই।
কিন্তু আমাদের নাগরিকদের কি কোনো দায়িত্ব নেই, করণীয় নেই?
প্রথম কথা হলো, সচেতনতা। কীটনাশকের নির্বিচার প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে, যদি সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলার জল ফল শস্য সবুজ আমরা বাঁচাতে চাই। কীটনাশক দিলে শুধু ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করা যায়, তা তো নয়, তা উপকারী পোকামাকড় কীট-জীবাণু, পাখপাখালিও বিনষ্ট করে। ওই বিষ মিশে যায় মাটিতে আর পানিতে। কত উপকারী প্রাণ যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই মেনে চলতে হবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিয়ম, পরিমাপ, মান। তার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে আমাদের করতে হবে বিকল্পের সন্ধান। সেটা ফল সংরক্ষণে ফরমালিন ব্যবহার বন্ধের জন্যও বটে, ফল পাকানোর জন্য কার্বাইডের ব্যবহার বন্ধের জন্যও বটে। এবং আমাদের দেশের সৃজনশীল মানুষই চমৎকার চমৎকার পরিবেশবান্ধব বিকল্প উদ্ভাবনও করছেন। নিমপাতা বেটে ছিটিয়ে দিলে পোকা হয় না, এটা প্রয়োগ করতে দেখেছি টেলিভিশনে প্রচারিত কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানে। আমাদের দেশে অনেকগুলো গ্রাম আছে, যে গ্রামগুলোকে স্থানীয় যুবকেরা ঘোষণা করেছেন পাখিবান্ধব গ্রাম হিসেবে, সেসব গ্রামে খেতে কোনো রকমের কীটনাশক দেওয়া হয় না, পাখিই সেখানে খেয়ে ফেলে ক্ষতিকর পোকা।
লিচুর পোকা নিয়ে নানা রকমের গল্প বহুকাল থেকেই এ দেশে প্রচলিত। একটা কৌতুক আছে, লিচুর পোকা থেকে বাঁচার উপায় হলো রাতের অন্ধকারে লিচু খেয়ে ফেলা। আজকাল লিচুতে পোকা থাকে না, তার মানে কিছু একটা করা হয়। কী করা হয়, এখন আমরা বেশ বুঝছি। বুঝছি স্বপনদের প্রাণের দামে।
কোনো বীরগঞ্জ উপজেলার কোনো সাদুল্লাপুরের স্বপনরা মারা গেলেই কী? বেঁচে থাকলেই কী? বহুদিন আগে, নব্বইয়ের দশকে এক জলোচ্ছ্বাসে লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটলে লেখক আহমদ ছফা ছুটে গিয়েছিলেন উপকূলীয় এলাকায়, সাংবাদিক নাজিম উদ্দীন মোস্তানকে বলেছিলেন, একজন মানুষের অপমৃত্যু হলেও পুরো জাতির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া উচিত।
আমিও তা-ই বলি, একটা প্রাণও আমরা অকালে অকারণে ঝরতে দেব না। একটা শিশুর মৃত্যুর খবরেও পুরো দেশকে নড়ে উঠতে হবে, পুরো দেশকে নাড়া দিতে হবে। মানুষের জীবন তো অপচয়িত হওয়ার জন্য নয়।
আর ওই গরিব মফস্বলের স্বপনরাই তো আজকের বাংলাদেশ, আগামীকালের বাংলাদেশ। কোন সাতক্ষীরার গ্রাম থেকে ৪৫ কিলোমিটার মোটরসাইকেলে চড়ে জেলা শহরে ক্রিকেট অনুশীলন করতে আসতেন মুস্তাফিজ, আজ তিনিই করেছেন বিশ্ব রেকর্ড। কক্সবাজারের গ্রাম থেকে এসেছেন মুমিনুল হক। নড়াইল থেকে মাশরাফি বিন মুর্তজা। আমরা কেউই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি, আর আমাদের মফস্বল শহরে কিংবা বন্দরের শৈশব ছিল উন্মুক্ত, বাধাহীন। পড়শির বাড়ির কাঁচা আম আমাদের ঢিলের অত্যাচারে কোনো দিনও পাকতে পারেনি, আর ছোটবেলায় লিচুগাছে জামগাছের ডালে চড়ে কাটিয়ে দিয়েছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কাঁচা লিচু মুখে দিয়ে গত বছরও খেয়েছি, রাঙামাটিতে গিয়ে, এবং সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করেছি, কাঁচা হলেও লিচুগুলো মিষ্টি। ভাগ্যিস, সেদিনের সেই লিচুতে অমন ভয়ানক বিষ অমন ভয়ানক মাত্রায় দেওয়া ছিল না।
সরকারের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে তাই আকুল আবেদন জানাব, আপনারা একটু নড়েচড়ে বসুন, মানুষকে সচেতন করুন, উদ্বুদ্ধ করুন। আমের বেলায় কিন্তু বেশ কিছু উদ্যোগের সফলতা এ বছর আমরা পেয়েছি। তবে সবচেয়ে বেশি দরকার নাগরিক উদ্যোগ। যেমন আমরা অকারণে গাড়ির হর্ন বাজাই। আমাদের ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে: ভেঁপু বাজান। আসলে ওখানে লেখা থাকা উচিত: হর্ন বাজাবেন না। গতকালের প্রথম আলোতেই প্রকাশিত হয়েছে এএফপির খবর: রাস্তার আওয়াজে আয়ু কমে। যানবাহনের তীব্র শব্দ থাকে, এমন এলাকায় বসবাস করলে আয়ু কমে যেতে পারে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ে। সভ্য দেশগুলোতে কেউ গাড়ির হর্ন বাজায় না। ওই সব দেশে কোনো গাড়ি যদি পেছন থেকে হর্ন বাজায়, সেটা সামনের গাড়ির চালকের কাছে চপেটাঘাতের চেয়ে অপমানসূচক বলে মনে হয়! এসব ব্যাপারে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে সচেতনতা সৃষ্টির আন্দোলন সূচনা করার জন্য।
বাগানে কিংবা খেতে কীটনাশক দেবেন না, দিতে হলে কৃষি বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত ওষুধ সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করে তারপর দেবেন—এই আওয়াজ তুলতে হবে আমাদেরই।
আর বারবার করে বলতে হবে, মানুষের প্রাণ অমূল্য। শিশুরা আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। আর একজন স্বপনকেও আমরা হারাতে চাই না, তাদের আমরা দিতে চাই নিরাপদ শৈশব, দিতে চাই শিক্ষা স্বাস্থ্য খাদ্য। আমাদের রাজনীতি, আমাদের উন্নয়ন, আমাদের মধ্য আয়ের দেশ হতে চাওয়ার প্রয়াস তো শিশুদের উন্নত জীবনের সন্ধান দেওয়ার জন্যই, তাদের বিপন্ন করার জন্য নয়। একই সঙ্গে রক্ষা করতে হবে আমাদের মাটি, আমাদের নদী, আমাদের বাতাস, আমাদের পানি, আমাদের ফুল আর ফসল, পাখি আর পতঙ্গও। লোভের বশবর্তী হয়ে লাভের পেছনে আমরা যে ন্যায়নীতিহীন দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছি, উন্নয়ন বলে যা আমাদের চোখে মায়াঞ্জন পরিয়ে রেখেছে, আমাদের বিবেককে ঢেকে দিয়েছে কালো আবরণে, তার প্রধান শিকার হচ্ছে প্রকৃতি, পরিবেশ—অর্থাৎ কিনা মানুষ, অর্থাৎ আমরাই। কাকে বলে উন্নয়ন, যদি না বাঁচে মানুষ?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.