যুক্তরাষ্ট্র নিজের বিষেই জরজর by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া

বিমর্ষ ওবামা। ছবি: রয়টার্স
বিষাক্ত বীজ বুনলে তা থেকে বিষবৃক্ষ হবেই। তার ফলও হবে বিষে ভরা। সে ফল যেখানেই যাক, বিষ ছড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বন্দুকবাজি আর রক্তঝরার ঘটনা তাদেরই বোনা বিষবৃক্ষের ফল বলেই মনে হচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পর্যন্ত এই বেপরোয়া অস্ত্রবাজি ও নির্বিচারে নিরীহ মানুষ হত্যার ঘটনায় ত্যক্তবিরক্ত। গত জুনের তৃতীয় সপ্তাহে সাউথ ক্যারোলাইনার একটি ঐতিহাসিক গির্জায় এক শ্বেতাঙ্গের আগ্নেয়াস্ত্র যখন নয়জন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের প্রাণ কেড়ে নেয়, ওই সময় ওবামার ক্ষোভ যেন নিষ্ফল আক্রোশ ও হতাশা হয়ে ঝরে পড়ে।
এ ঘটনায় হোয়াইট হাউসের মঞ্চে বিবৃতি দিতে গিয়ে ওবামা বলেন, ‘এ ধরনের বিবৃতি আমি বহুবার দিয়েছি।’ এ সব ঘটনা থেকে দেশবাসীকে বিরত থাকতে বলতে বলতে তিনি যে হয়রান, এটা পরিষ্কার বোঝা গেছে সেদিন। ওবামা স্বীকারও করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো এমন শিক্ষাদীক্ষা এবং আধুনিকতায় আগুয়ান আর কোনো দেশে এ ধরনের সহিংসতা ঘটে না।
যুক্তরাষ্ট্রে আচমকা গুলি ছুড়ে নিরীহ মানুষ হত্যার সর্বশেষ ঘটনা ঘটে গত ২৩ জুলাই। ওই দিন লুইজিয়ানার একটি সিনেমা হলে ছবি চলার সময় অস্ত্রধারী এক ব্যক্তি এলোপাতাড়ি গুলি করে দুজনকে মেরে নিজেও মরেছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে সাতজন।
যুক্তরাষ্ট্রে হুটহাট এমন অস্ত্রবাজির ঘটনা বহু বছর ধরেই ঘটছে। তবে এ বছর যেন তা বেড়ে গেছে। ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর সে দেশে এ পর্যন্ত ২০৪ দিনে ২০৪টি আগ্নেয়াস্ত্র-বিষয়ক সহিংস ঘটনা ঘটেছে।
যুক্তরাষ্ট্র একটি আগ্নেয়াস্ত্রের দেশ। ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরি এবং বিক্রি করা তাদের ব্যবসা। নিজেরা পারমাণবিক মারণাস্ত্র মজুত করে বসে আছে, কিন্তু ইরান আর উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনা আর চুল্লি নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নেই। নিজেরা তো বটেই, সঙ্গে পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার লাগাম টেনে ধরতে চেষ্টার বিরাম নেই। এ চেষ্টায় ব্যবহার করার হচ্ছে নানা ধরনের অর্থনৈতিক অবরোধের ফাঁস।
মার্কিন নেতারা যুদ্ধকবলিত দেশগুলোর দিকে আঙুল তুলে হরহামেশা গলা চড়িয়ে বলছেন, অস্ত্রের ঝনঝনানি থামাও, সহিংসতা বন্ধ করো, শান্তির পথ ধরো। তাঁদের দেশ থেকেই আবার প্রতি বছর মধ্যপ্রাচ্য, তুরস্ক, ইসরায়েলসহ বিভিন্ন দেশে টনকে টন অস্ত্র রপ্তানি করা হচ্ছে। প্রকাশ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্রের ব্যবসা করছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্র মুখে মুখে সাম্যের গান গায়, কিন্তু নিজেরাই বর্ণবাদের লেবাসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। এই বিষাক্ত বীজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ প্রশাসনের গভীরে রয়ে গেছে। গত বছর আগস্টে মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের ফার্গুসন শহরে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ নিহত হওয়ার ঘটনা এর বড় উদাহরণ। এমন ঘটনা অতীতেও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
সাপুড়ে যেমন সাপ নিয়ে খেলে, যুক্তরাষ্ট্র তেমনি অস্ত্র নিয়ে খেলছে। সাপ যেমন প্রাণঘাতী, অস্ত্রও তাই। সাপ সাপুড়ের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। তারা সাপ পোষে। দন্তহীন সাপের খেলা দেখিয়ে, বিষধর সাপ বিক্রি করে পেট চালায়। সাপুড়েদের ঘরদুয়ারে ছড়িয়ে থাকে সাপ। তেমনি যুক্তরাষ্ট্রেও আগ্নেয়াস্ত্র খুব সহজলভ্য। আত্মরক্ষার নাম করে সে দেশে খুব সহজেই হালকা বা ভারী অস্ত্র বাগানো যায়।
বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বেসামরিক লোকজনের হাতে ২৮ কোটির বেশি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র রয়েছে। সে দেশে প্রতি বছর গড়ে ৪৫ লাখ আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি হয়ে থাকে। প্রতি বছর গড়ে পুরোনো আগ্নেয়াস্ত্রই বিক্রি হয় প্রায় ২০ লাখ।
ইউএস গান ভায়োলেন্স স্ট্যাটেসটিকস বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে ৩০ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়। তাদের অর্ধেকের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। অনেকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র-বিষয়ক সহিংসতার মূল কারণে অস্ত্রের সহজলভ্যতা। ঘরে ঘরে অস্ত্র থাকার কারণে রক্তক্ষয়ী ঘটনাও কম ঘটে না।
এএফপির খবরে জানানো হয়, গত মে মাসে ভার্জিনিয়ার একটি বাড়িতে দুই বছরের এক শিশু খেলতে খেলতে ড্রয়ারে পেয়ে যায় গুলিভরা আগ্নেয়াস্ত্র। সেটার নল মাথায় ঠেকিয়ে অবলীলায় ট্রিগার টিপে দেয় সে। ফল যা হওয়ার তাই। গত বছর ওকলাহোমার বাড়িতে তিন বছরের এক শিশু একইভাবে আগ্নেয়াস্ত্র পেয়ে গুলি করে বসে মাকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি শেষ। এমন ঘটনার কথা বলে শেষ করা যাবে না।
এসব বন্দুকবাজি ও হত্যার ঘটনা খতিয়ে দেখে দ্য হার্ভার্ড ইনজুরি কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টারের বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোথাও আগ্নেয়াস্ত্র বেশি থাকলে সেখানে যে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটে, এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে।
অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে এখন জনসংখ্যা বাড়ছে, অভিবাসন-প্রত্যাশী বাড়ছে, মানুষের মানসিক চাপ ও অস্থিরতা বাড়ছে, অর্থনৈতিক দুর্গতি বাড়ছে। এসব কারণে কিছু মানুষ বেপরোয়া হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হতাশার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটাচ্ছে।
মার্কিন অর্থনীতিবিদ রিচার্ড ফ্লোরিডা বলেছেন, এসব মূল কারণ নয়। দেখা গেছে, যেসব অঙ্গরাজ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন তুলনামূলকভাবে কঠোর, সেসব অঙ্গরাজ্যে সহিংসতাও কম।
মাইকেল ব্রাউন হত্যার ঘটনায় ফারগুনে সহিংসতা। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.