ইয়াকুবের পর এবার আফতাব আনসারিকে নিয়ে তটস্থ প্রশাসন

জেলের চার দেওয়ালের চৌহদ্দিতেও তাকে অষ্টপ্রহর যেন চোখে হারান কারা-কর্তারা। অন্তত গত চার বছরে জেল চত্বরে একটি মুহূর্তের জন্যও তাকে নজরের আড়াল হতে দেয়া হয়নি। খাদিম-কর্তা অপহরণ ও আমেরিকান সেন্টারে হানাদারির ‘হাই প্রোফাইল’ আসামি আফতাব আনসারির ক্ষেত্রে নিরন্তর সতর্কতার সেই ধারাবাহিকতায় এ বার বুঝি ছেদ পড়তে চলেছে। কারণ, আফতাবের  চোখের ছানি। আগস্টে কলকাতার কোনও সরকারি হাসপাতালে তার ছানি অপারেশন হবে বলে নবান্ন-সূত্রের খবর। এ জন্য তাকে হাসপাতালে দু’-এক দিন রাখতেও হতে পারে। তাতেই ঘুম ছুটেছে অফিসারদের। আমেরিকান সেন্টারে হামলা-মামলায় ফাঁসির খাঁড়া ঝুলছিল আফতাবের সামনে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন হয়েছে। আপাতত আলিপুর জেলের এক নম্বর সেলের বাসিন্দা আফতাব এই মুহূর্তে তর্কাতীত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বিপজ্জনক বন্দি। এবং যতই দরকার থাক, তাকে জেলের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে সময়টা মোটেই উপযুক্ত নয়। সদ্য সদ্য ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি হয়েছে, যার প্রেক্ষিতে দেশ জুড়ে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করেছে  কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এ রাজ্যেও প্রশাসন তটস্থ। গোয়েন্দাদের অনুমান, ইয়াকুবের ফাঁসির বদলা নিতে পাকপন্থী জঙ্গিরা দেশের যে কোনও প্রান্তে মরণ-কামড় দিতে চাইবে। বস্তুত পঞ্জাবের গুরদাসপুরের জঙ্গি হামলার পিছনেও ইয়াকুবের ফাঁসির ছায়া দেখেছেন গোয়েন্দাদের একাংশ।
এমতাবস্থায় প্রশাসনের অন্দরে আশঙ্কা, আফতাবকে জেলের বাইরে পেলে তাকে ‘উদ্ধারে’র চেষ্টা হতেই পারে। তাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও রাজ্য সরকারের তরফে জেল-কর্তাদের কাছে নির্দেশ গিয়েছে, আফতাবের ছানি কাটানোর প্রক্রিয়াটি যেন অতি সাবধানে ও চূড়ান্ত নিরাপত্তার ঘেরাটোপে সারা হয়।
আফতাবকে ঘিরে জেল-কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা অবশ্য বরাবরই। চার বছর আগে দিল্লির তিস হাজারি  কোর্টের এক মামলায় তাকে হাজির করতে সকালের বিমানে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সন্ধের মধ্যে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। তার পরেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ফরমান দেয়, আফতাবকে জেলের বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সেই ইস্তক জেল চত্বরের বাইরে সে পা রাখেনি। পয়লা নম্বর সেল মুড়ে ফেলা হয়েছে সিসি ক্যামেরার নজরদারিতে। এমনকী, সেলের ভিতরেই ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের বন্দোবস্ত করে তার বিভিন্ন মামলার শুনানি হয়েছে। এতেও অবশ্য সব সময় আফতাবের ‘কার্যকলাপ’ রোখা যায়নি। কখনও সে জেলে বসে মোবাইলে কথা বলেছে, কখনও  ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছে। কুঠুরিতে বসে স্কাইপ করতেও ছাড়েনি! করাচিবাসী স্ত্রীর সঙ্গে আফতাবের ফোনালাপ গত অক্টোবরেই গোয়েন্দা-রেডারে ধরা পড়েছিল।
এ হেন লোক তো সুযোগ পেলেই চম্পট দিতে পারে, হামলার ছক কষাও বিচিত্র নয়। তাকেই কিনা  জেলের বাইরে নিয়ে যেতে হচ্ছে! কিচ্ছু করার নেই! জেলের হাসপাতালে এ সব অপারেশন করানো যাবে না। বলছিলেন কারা দপ্তরের এক কর্তা। তার কথায়, ইনফেকশন হয়ে চোখের কোনও ক্ষতি হলে আর এক গেরো! বাধ্য হয়ে তারা বাইরের হাসপাতালে আফতাবের ছানি অস্ত্রোপচার করানোর বিশেষ অনুমতি চেয়েছিলেন দিল্লির কাছে। অনুমতি মিলেছে। স্থির হয়েছে, আফতাবকে এমন  কোনও সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে উন্নত ও পরিচ্ছন্ন অপারেশন থিয়েটার আছে। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী দেখভালের স্বার্থে দরকার পড়লে তাকে যাতে দু’-এক দিন হাসপাতালে রাখা যায়, রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় সে অনুমতি দিয়েছেন। ছানি অপারেশনের এক দিন বাদে সাধারণত একটা চেক-আপের দরকার পড়ে। সে ক্ষেত্রে আফতাবকে যাতে বারবার আনা-নেয়া করতে না হয়, সে কথা মাথায় রেখেই প্রয়োজনে তাকে হাসপাতালে দু’-এক দিন রাখার কথা ভাবা হচ্ছে।
ঠিক হয়েছে, কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের প্রহরায় আফতাবের চিকিৎসার কাজটা সারা হবে। ‘অতীব ঝুঁকিপূর্ণ’ দায়িত্বটি নির্বিঘে সম্পন্ন করতে জেল-কর্তারা আঁটঘাট বেঁধে নেমেছেন। কিন্তু আফতাবের ছানি কাটানোটা হঠাৎ এত জরুরি হয়ে পড়ল কেন?
জেল-সূত্রের খবর: কলকাতার আমেরিকান সেন্টারে হানাদারির এক দিন পরে (২০০৩-এর ২৩ জানুয়ারি) দুবাইয়ে ধরা পড়েছিল যে তরতাজা ছেলেটি, সে এখন মধ্য চল্লিশ। চালশে ধরেছে। সঙ্গে ডায়াবিটিস, যাতে চোখের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন জেলের ডাক্তারেরা। আফতাব নিয়মিত ডায়াবিটিসের ওষুধ খায়। তবু ব্লাড সুগার ২০০-২৪০। একেই চলাফেরার পরিধি নিয়ন্ত্রিত, উপরন্তু ‘ভিআইপি’ বন্দি হওয়ার সুবাদে খাটাখাটনি কম। সব মিলিয়ে সুগার আরও গেড়ে বসছে। কলকাতার এক সরকারি সংস্থার ডাক্তারেরা সম্প্রতি জেলে গিয়ে আফতাবের শারীরিক অবস্থা খুঁটিয়ে দেখেছেন। তাদের পর্যবেক্ষণ, ওর বাঁ চোখের ছানি না-কাটালেই নয়।
সেটা না-হওয়া পর্যন্ত আফতাবের চোখে নিয়মিত দু’ধরনের ড্রপ পড়েছে। একটা সংক্রমণ এড়াতে, অন্যটা দেয়া হচ্ছে যাতে চোখ শুকিয়ে না-যায়। পাশাপাশি চলছে ‘ডায়াবেটিক ডায়েট।’ ভাত-সহ কার্বোহাইড্রেট খাবারে রাশ টানা হয়েছে।
অর্থাৎ ‘উঁচু দরের’ কয়েদিকে সুস্থ রাখতে যা যা করণীয়, সবই হচ্ছে। কর্তাদের চিন্তা শুধু একটাই নিজের চোখ সারাতে গিয়ে আফতাব তাদের চোখে ধুলো দেবে না তো? চার কুঠুরির আড়ালে  থেকেও তামাম কারা-প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে আফতাব আনসারি।
সূত্র: আনন্দবাজার

No comments

Powered by Blogger.