ঈদের ছুটিতে সাগরসৈকতে পর্যটকের ঢল by আব্দুল কুদ্দুস

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গোসল করছেন পর্যটকেরা
ঈদুল ফিতরের দিন গতকাল শনিবার কক্সবাজারের সাগরসৈকতে ছুটি উপভোগে প্রায় দেড় হাজর পর্যটকের সমাগম ঘটে। ঈদের ছুটিতে প্রতিবছরের মতো এবারও সেখানে প্রচুর পর্যটক আসবেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এই সৈকত শহরে হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস আছে প্রায় ৪০০টি। এখানে দৈনিক ৭৭ হাজার পর্যটকের রাতযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে ভ্রমণে আসা লাখো পর্যটককে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত কক্সবাজার।
হোটেল মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারে গতকাল প্রায় দেড় হাজার অতিথি অবস্থান করেন। আজ রোববার অতিথির সংখ্যা বেড়ে ৪৫ হাজারে পৌঁছাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ঈদের তৃতীয় দিন হবে ৭০ হাজারের বেশি অতিথি। অধিকাংশ হোটেল, মোটেল ও গেস্টহাউসের কক্ষগুলো আগাম ভাড়া নেওয়া হয়েছে।
হোটেল, মোটেল ও গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদারের ভাষ্য, পর্যটকের নানার বাড়ি হচ্ছে কক্সবাজার। ঈদের দিন থেকে পর্যটকেরা নানার বাড়িতে আসা শুরু করছেন। এরপর টানা সাত দিন সৈকতে সমাগম ঘটবে লাখো পর্যটকের। পর্যটক টানতে হোটেল-মোটেলে আলোকসজ্জাসহ নানা বিনোদনের আয়োজনও রাখা হয়েছে।
সমুদ্রসৈকত ভ্রমণের পাশাপাশি পর্যটকেরা দল বেঁধে ছুটছেন টেকনাফ, মাথিন কূপ, সেন্ট মার্টিন, প্যাঁচার দ্বীপ মারমেইড ইকো বিচ রিসোর্ট, হিমছড়ি, বৌদ্ধপল্লি, সাফারি পার্কসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় অনেকে বিপদে পড়ছেন। হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেকে। জোয়ার ভাটার হিসাব না করে সমুদ্রে গোসলে নেমে বিপদে পড়েন কেউ কেউ। প্রিয়জনের দুরবস্থায় তখন আনন্দের ভ্রমণ তেতো হয়ে যায়। এ জন্য দরকার সতর্কতা।
সৈকত রানির রূপ
পাহাড়ের পাদদেশে সৈকত রানির নরম বালুচরে সকাল-বিকেল খালি পায়ে হাঁটাচলা, দৌড়ে রাজকাঁকড়া ধরার আপ্রাণ চেষ্টা, গভীর সাগর দিয়ে মাছ ধরে জেলেদের ফিরে আসার দৃশ্য, সাগরের লোনা জলে শরীর ভিজিয়ে নেওয়ার মুহূর্ত মনকে সতেজ ও উৎফুল্ল করে তোলে। মনে হবে, ভ্রমণটা সার্থক হচ্ছে।
সৈকতের বালুচর লাগোয়া বিশাল ঝাউবাগান। ঝাউবীথির মাঝে দাঁড়িয়ে কয়েকটি ছবি তুলে নিন। মধুর স্মৃতি হয়ে থাকবে এই ছবি। হাতে সময় থাকলে অরণ্য ঘেরা পাহাড়, রাখাইনদের মন্দির, ক্যাং, জাদি, বার্মিজ ও ঝিনুক মার্কেট ঘুরে আসতে পারেন।
পাহাড়ি ঝরনার হিমছড়ি
এক পাশে উঁচু পাহাড়, অন্য পাশে উত্তাল সাগর। মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে চলে গেছে দীর্ঘ ৮৪ কিলোমিটারের ‘কক্সবাজার-টেকনাফ’ মেরিন ড্রাইভ সড়ক। এই সড়ক ধরে ১৫ কিলোমিটার গেলে পাহাড়ি ঝরনার হিমছড়ি। হিমছড়ির পাহাড় চূড়ায় ওঠার জন্য রয়েছে কয়েক শ ফুট উঁচু পাকা সিঁড়ি। পাহাড় চূড়ায় উঠে নিচের গ্রাম ও সমুদ্র দেখতে দারুণ লাগে। মনে হবে সাগরের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন।
মারমেইড ইকো রিসোর্ট, পাথুরে সৈকত
হিমছড়ি থেকে আরও ১০ কিলোমিটার গেলে প্যাঁচার দ্বীপে পরিবেশবান্ধব পর্যটন পল্লি ‘মারমেইড ইকো বিচ রিসোর্ট’। যেখানে ৯০ শতাংশ অতিথি বিদেশি। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কচ্ছপ ভাস্কর্যটি এখানেই তৈরি। সন্ধ্যার পর এই পল্লির আলোকসজ্জা মানুষের নজর কাড়ে। এখান থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ইনানী সৈকত। পাথরস্তূপ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বলে এটি পাথুরে সৈকত। এখানে থাকা-খাওয়ার জন্য বন বিভাগের একটি বাংলোসহ আধুনিক মানের কটেজ রিসোর্ট আছে।
নাফ নদী-মাথিন কূপ
টেকনাফ থানার ভেতর মনোরম পরিবেশে সাহিত্যিক ধীরাজ ভট্টাচার্য্য ও মগ জমিদার-কন্যা মাথিনের ঐতিহাসিক প্রেমের নিদর্শন ‘মাথিন কূপ’।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আতাউর রহমান খন্দকারের ভাষ্যমতে, প্রতিবছর প্রায় ছয় লাখ পর্যটক এই কূপটি পরিদর্শন করেন। এই কূপ নিয়ে অনেক বই, নাটক, ছায়াছবি, গল্প, কবিতা হয়েছে। পর্যটকদের কাছে টেকনাফ মানে ‘মাথিন কূপ’।
হাতে সময় থাকলে দেখতে পারেন, দেড় কিলোমিটার দূরে টেকনাফ সমুদ্রসৈকত, নাফ নদীর তীরের নেটং (দেবতার পাহাড়) পাহাড়, ঐতিহাসিক ব্রিটিশ বাঙ্কার, জালিয়ারদিয়া, এলিফ্যান্ট পয়েন্ট, মিয়ানমার সীমান্ত, বৌদ্ধমন্দির, পানের বরজ ইত্যাদি।
প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন
টেকনাফ থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে ভাসমান প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন। দ্বীপের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে প্রবাল, শৈবাল আর শামুক-ঝিনুক। দেখা যায়, সারি সারি নারকেলগাছ আর সাগর উপকূলে মাছ শিকারে ব্যস্ত হাজারো গাঙচিল। সেন্ট মার্টিনে থাকার জন্য ৩৩টি আবাসিক হোটেল ও ২০টির মতো রেস্তোরাঁ আছে। ঈদের পরদিন থেকে পর্যটকদের পারাপারে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে চালু হয়েছে একটি জাহাজ। এখন সমুদ্র উত্তাল। তাই দেশীয় ট্রলারে সেন্ট মার্টিন না যাওয়াই নিরাপদ।
বৌদ্ধমন্দির-রাখাইনপল্লি
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার আসার পথে সারি সারি রাবার বাগান জানান দেবে—এটি রামু। রামুতে দেখতে পাবেন ১০০ ফুট লম্বা সিংহ শয্যা গৌতম বুদ্ধের মূর্তি, আধুনিক মানের বৌদ্ধবিহার, রাখাইন মন্দির, রামকোট বনাশ্রম তীর্থধাম, জগৎজ্যোতি শিশু সদন, জাদি ও সম্রাট শাজ সুজা সড়ক।
কক্সবাজার শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে মহেশখালী দ্বীপ। এখানকার মৈনাক পাহাড় চূড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ‘আদিনাথ মন্দির’। পাহাড়ের নিচে রাখাইনপল্লি। বিচিত্র তাদের জীবনযাপন। রাখাইন তাঁত ও কুটিরশিল্প, মন্দির, প্যাগোডা ভালো লাগবে। কক্সবাজার শহর থেকে স্পিডবোট ও লঞ্চে মহেশখালী যেতে হয়। সাগর উত্তাল থাকলে ঝুঁকি না নেওয়াই উত্তম।
ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক
শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। পার্কে হেঁটে বা গাড়িতে করে গেলে দেখা যায় বাঘ, ভালুক, সিংহ, হাতি, কুমিরসহ নানা পশুপাখি। হাতির পিঠে চড়ে পার্ক পরিদর্শনের সুযোগ তো আছেই। আছে ২৫ মিনিটের বন্য প্রাণী ও গাছপালা দেখার ‘প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র’।

No comments

Powered by Blogger.