উপ-আঞ্চলিক জোট ও বাণিজ্য করিডর by আসজাদুল কিবরিয়া

অবশেষে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে নিয়ে গঠিত বিবিআইএন নামক উপ-আঞ্চলিক জোট একটি আনুষ্ঠানিক রূপ পেল। আর তা সম্ভব হলো চার দেশের মধ্যে মোটরযান চুক্তি (এমভিএ) স্বাক্ষরের মাধ্যমে। আসলে দীর্ঘ দুই দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততার পাশাপাশি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের বিষয়ে যথেষ্ট আলাপ-আলোচনা হয়েছে, গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে। কিন্তু কার্যকর অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।
মোটাদাগে একই অঞ্চলের কয়েকটি ছোট দেশ তাদের প্রতিবেশী বড় একটি দেশের এক বা একাধিক প্রদেশকে নিয়ে গঠিত জোটকে উপ-আঞ্চলিক জোট বলা যায়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে সামনে আনা হয় বৃহত্তর মেকং উপ-অঞ্চল। কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং চীনের ইউনান ও গুয়াংজি প্রদেশদ্বয়কে নিয়ে এই গঠিত। গুয়াংজি বাদে অন্যগুলো সবই মেকং নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। ১৯৯২ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বৃহত্তর মেকং উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবর্তন করে।
দক্ষিণ এশিয়ায়ও এ ধরনের একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের জন্য এডিবির চেষ্টা বেশ পুরোনো। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানটি সাউথ এশিয়ান সাব-রিজিয়নাল কো-অপারেশন (সাসেক) নামে একটি জোট গঠনের ঘোষণা দেয়, যার সদস্য হয় বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। কিন্তু এটি আসলে উপ-আঞ্চলিক জোট হতে পারেনি, বরং ‘পাকিস্তান বাদে সার্ক’ এমন একটি জোটের ধারণাই জোরালো হয়েছে। তা ছাড়া এখানে দুটি দেশ হলো দ্বীপরাষ্ট্র, যাদের সঙ্গে স্থল ও রেলপথে যোগাযোগের সুযোগ নেই। সর্বোপরি বিশাল রাষ্ট্র ভারতের নির্দিষ্ট কোনো প্রদেশ নয়, বরং পুরো দেশটিই এর সদস্য বিবেচিত হয়েছে। ফলে এই উদ্যোগে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
অবশ্য বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব সাত রাজ্য ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের প্রয়াস অনেক পুরোনো। এর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্নভাবে পশ্চাৎপদ তিনটি দেশ ও ভারতীয় প্রদেশগুলোর পরস্পরের মধ্যে সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরদার করা। বিবিআইএনের মোটরযান চুক্তি সেই সম্পৃক্ততার পথে একটি বড় ধাপ বলে বিবেচিত হতে পারে। এই চুক্তির আওতায় চার দেশের যানবাহন একে অন্যের দেশে যাতায়াত করতে পারবে। অবশ্যই তা অবাধে নয়, নিয়ন্ত্রিতভাবে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিতভাবে বা সীমিত পরিসরেই তা হওয়া উচিত। এরপর প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুসারে এই নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা যাবে। চার দেশের মধ্যে যান চলাচলের সুযোগ পর্যায়ক্রমে মানুষ ও পণ্য পরিবহন সহজ করবে এবং দেশগুলোর পরম্পরের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াবে।
সন্দেহ নেই ভারত সরকারের সক্রিয় উদ্যোগেই বিবিআইএন গতি পেয়েছে। ২০১৩ সালে ভারতের কংগ্রেস সরকার এই উপ-আঞ্চলিক সম্পৃক্ততার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হওয়ায় এবং পরের বছরগুলোয় সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক উন্নত হওয়ায় ভারতের জন্য এই উদ্যোগ কার্যকর করা সহজ হয়। বরাবরই ভারত তার যেকোনো উদ্যোগে নেপাল ও ভুটানকে অনেক সহজেই সঙ্গে পেয়েছে। কিন্তু সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকায় বাংলাদেশকে পাশে পাওয়া সহজ হয়নি। আবার বাংলাদেশও বিভিন্ন কারণে বিশেষত ভারতের অতিমাত্রায় নিজ স্বার্থকেন্দ্রিক আচরণ ও ছাড় দিতে অনীহ মনোভাবের জন্য উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগে উৎসাহ পায়নি। তার বদলে সার্কের আঞ্চলিক জোটকেই তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক মনে করেছে। অন্যদিকে ভারত বেশির ভাগ সময়ই সার্কের বিষয়ে উদাসীন ও সন্দিহান থেকেছে। প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে চিরশত্রুতার কালো ছায়া সার্কের সম্ভাবনা ও অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে।
তবে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতের বৈদেশিক নীতি একই সঙ্গে প্রতিবেশীদের প্রতি অধিক বন্ধুবৎসল হয়ে ওঠে। সার্কের তথা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা বাড়াতেও আগ্রহ প্রকাশ পায়। তবে গত বছর নভেম্বরে কাঠমান্ডুতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় মোটরযান, রেল ও বিদ্যুৎ সংযোগ-বিষয়ক তিনটি চুক্তি স্বাক্ষরে পাকিস্তান বাগড়া দিলে তা প্রকারান্তরে ভারতের জন্য আশীর্বাদ হয় ওঠে। ভারত দ্রুত বিবিআইএন নিয়ে অগ্রসর হয়। অথচ সার্কের আওতায় চুক্তিগুলো হলে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানও অভিন্ন সড়ক ও রেল যোগাযোগের আওতায় আসতে পারত।
বিবিআইএন জোটের মাধ্যমে নেপাল ও ভুটান এখন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাবে সহজে। ভারতের কলকাতা বন্দর ব্যবহারও আগের চেয়ে সহজ হবে। বাংলাদেশ অবশ্য বরাবরই নেপাল ও ভুটানকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দিতে চেয়েছে। কিন্তু ভারত তার ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দিতে রাজি হয়নি বলে সেটি সম্ভব হয়নি। অথচ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতি-বিধি অনুসারে ভূ-আবদ্ধ কোনো দেশকে (নেপাল বা ভুটান) দ্বিতীয় দেশ (ভারত) তৃতীয় দেশে (বাংলাদেশে) যাওয়ার জন্য ট্রানজিট সুবিধা দিতে বাধ্য। ভারত কখনোই তা অনুসরণ করেনি, যদিও গত কয়েক বছরে অনেক কিছুতে দেশটি নমনীয় হয়ে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে।
মজার বিষয় হলো ২০১১ সালেই বাংলাদেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট প্রদানের জন্য নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ট্রানজিট-বিষয়ক একটি মূল দল গঠন করা হয়। এই দল একটি সর্বাত্মক প্রতিবেদন তৈরি করে, যেখানে ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্টের বিভিন্ন কৌশলগত, কারিগরি ও ভূরাজনৈতিক দিক বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ রাখা হয়। সে বিবেচনায় বাংলাদেশই আসলে বিবিআইএনের পথিকৃৎ। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নীতিনির্ধারক ভারতকে একতরফাভাবে ও অবাধে ট্রানজিট সুবিধা দিতে সচেষ্ট থাকায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনটি হিমাগারে চলে যায়।
বিবিআইনের আন্ত-আঞ্চলিক বাণিজ্য বা দেশগুলোর পরস্পরের মধ্যে বাণিজ্য ২০১৪ সালে ২ হাজার ৪৩০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা এক দশক আগে ছিল মাত্র ৫৭৮ কোটি ডলার। সার্ক বাণিজ্যের ৪৯ শতাংশই বিবিআইএনে সম্পন্ন হয়। ২০১৩ সার্ক আন্ত-আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার। একই সময়ে বিবিআইএনের এ বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ১৯৩ কোটি ডলার। মোটরযান চুক্তি বিবিআইএনের বিদ্যমান বাণিজ্য করিডরগুলোর উন্নয়ন ও সংস্করণের একটি সুযোগও তৈরি করেছে। আর এসব বাণিজ্য পথ বা করিডরগুলো উন্নত না হলে পারস্পরিক বাণিজ্য বাড়বে না, কমবে না ব্যবসার ব্যয়।
বিবিআইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় বাণিজ্য করিডর হলো কাঠমান্ডু-কাকরভিটা/ পানিটাঙ্কি-ফুলবাড়ী/বাংলাবান্ধা-হাটিকুমরুল-ঢাকা। ১ হাজার ৪৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একই ত্রিদেশীয় সড়কপথে নেপালের অংশ ৬০০ কিলোমিটার, ভারতের ৫৪ কিলোমিটার আর বাংলাদেশের ৪৯৮ কিলোমিটার। এটি প্রধানত বাংলাদেশ ও নেপালের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পন্ন হয়। ভারতও কখনো কখনো এটি ব্যবহার করে। যদি ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সড়কপথকে বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলে এর মোট দূরত্ব দাঁড়াবে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। আর যদি বাংলাবান্ধা থেকে মংলা পর্যন্ত চলে আসে তাহলে মোট দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১ হাজার ৩২৯ কিলোমিটার। সার্ক রিজিয়নাল মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট স্টাডি (এসআরএমটিএস) এই পথটিকে ‘সার্ক হাইওয়ে করিডর-৪’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
কিন্তু অবকাঠামোজনিত ঘাটতি এই বাণিজ্য করিডরে তো বটেই, অন্য করিডরগুলোয় বাণিজ্য সম্পন্নকরণকে কঠিন করে রেখেছে। ভারতের জয়পুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাটস ইন্টারন্যাশনাল চলতি বছর তাদের প্রকাশিত এক সমীক্ষায় এ বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। তাতে এই বাণিজ্য করিডর সম্পর্কে বলা হয়েছে, নেপালের দিকে কাকরভিটা শুল্ক স্টেশনে শুধু রাসায়নিক পরীক্ষাগার ছাড়া আর প্রায় সবই ভালোভাবে আছে। বাংলাদেশের দিকে বাংলাবান্ধায় সড়কের অবস্থা ভালো থাকলেও পণ্যবাহী ট্রাক রাখার জায়গার অভাব আছে, প্রয়োজনীয় পণ্যগুদাম নেই। ভারতের দিকে নেপালসংলগ্ন স্যানিটারি অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। নেই পণ্যগুদাম ও ভালো পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। এখানকার শুল্ক স্টেশনে স্থায়ী কোনো কর্মকর্তা নেই। পানিটাঙ্কি ও কাকরভিটা সংযোগ স্থাপনকারী সেতুটা সংকীর্ণ।
এই একটি উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর কতটা অপ্রতুলতা আছে এই সিবিআই জোটের দেশগুলোয়। অবকাঠামোর উন্নয়ন ছাড়া প্রত্যাশিত উপ-আঞ্চলিক বা আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা যেমন হবে না, তেমনি হবে না কাঙ্ক্ষিত বাণিজ্য। তাই বাণিজ্য করিডরগুলোর উন্নয়ন, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে বিনিয়োগ করতে হবে চার দেশকেই। তবে প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে ভারতেরই উচিত বেশি বিনিয়োগ করা। আর উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য করিডরগুলোর কয়েকটি ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যাতায়াত ও যোগাযোগ সহজতর ও সাশ্রয়ী করবে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ইতিমধ্যেই একাধিক পরিবহন করিডরে যান চলাচল শুরু করেছে। পরিবহন করিডরকে বাণিজ্য করিডর ও তারপর অর্থনৈতিক করিডরে রূপান্তর ঘটানোর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে বড় বিনিয়োগে ভারতের পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.