'অসাধারণ' স্বচ্ছল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক by আহমেদ জায়িফ

আপডেট ১৯ জুলাই, ২০১৫ঃ প্রতিবেশীদের কাছে দেবু নামে পরিচিত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। জামালপুরের পাথালিয়ার একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। বাবা ছিলেন চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারি। একতলা টিনশেডের একটি বাড়ি ছিল তাদের। কিন্তু ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর বদলে গেছে অবস্থা। টিনশেডের জায়গায় উঠেছে তিনতলা দালান। দেওয়ানগঞ্জ ফুড ডিপো নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালাতে শুরু করেছেন নাজমুলের বাবা। ঢাকায় বিলাশবহুল ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করেছেন নাজমুল।
পাথালিয়ায় নাজমুলের এক প্রতিবেশী জানান, নাজমুলের বাবার পক্ষে আর্থিক অবস্থায় নাটকীয় পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল না। এটা হয়েছে নাজমুল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর।
নতুন বাড়ি তৈরি সম্পর্কে নাজমুল বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ১৯৯২ সালে ওই বাড়িটির নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন তার বাবা। ২০১০ সালে এটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। সম্প্রতি বাড়িটিতে রং করা হয়েছে তাই নতুন লাগছে। কিন্তু ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, নাজমুলের বাড়িতে গিয়ে নতুন ভবন দেখে এসেছেন তিনি।
বিলাসবহুল ফ্ল্যাট
রাজধানীর পরীবাগের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। প্রতিমাসে ভাড়া ৫০ হাজার টাকা। ওই বাড়ির কেয়ারটেকার কামাল পাশা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এটি একটি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট। দুই মাস যাবত নাজমুল এখানে বসবাস করছেন। তবে নাজমুল বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আওয়ামী লীগের এক নেতা ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছেন। তিনিই অর্ধেক ভাড়া দেন।
সূত্র জানায় রাজধানীর ওল্ড ডিওএইচএস-এ একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন নাজমুল। ওই বাড়ির কেয়ারটেকার জয়নাল আবেদীন বলেন, 'গত এক বছর ধরে ১৪শ স্কয়ার ফুটের ওই ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকছেন নাজমুল। এই ফ্ল্যাটের ভাড়া ৩৫ থেকে ৪০ হাজার।' তবে নাজমুল বলেন, 'ওই ফ্ল্যাটের মালিক দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ইশতিয়াক দিদার। উনি আমার চাচাত ভাই। এই বাড়িতে বসবাস করতে আমাকে কোনও টাকা দিতে হয় না।'
তিনি বলেন, 'আমি এমপি মন্ত্রী নই। অবৈধ টাকা আয় করি না। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগ আমার কিছু খরচ বহন করে। মাঝে মাঝে সংগঠনের সাবেক নেতারা সহায়তা করেন। তবে আমি প্রধানত আর্থিক সহযোগিতা পাই আমার পরিবার থেকেই।'
বিবার্তা২৪ ডট কম
বিবার্তা২৪ডটকম নামে একটি নিউজ পোর্টালের প্রকাশক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পোর্টালটির এক সাংবাদিক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ২০১২ সালে আগস্ট মাসে পোর্টালটির উদ্বোধন হয়। ২০১৩ সালের দিকে পোর্টালের পার্টনার হন নাজমুল। পরে প্রকাশকও হন তিনি।
তবে নাজমুল দাবি করেন, পোর্টালের সম্পাদকই তাকে প্রকাশক বানিয়েছে। কারণ সম্পাদকের ধারণা তাকে প্রকাশক বানালে বিজ্ঞাপন বেশি পাওয়া যাবে। নাজমুল বলেন, 'তার অনুরোধের ভিত্তিতে আমি গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমি তাদের বিজ্ঞাপন পেতে সহায়তা করি। তবে পোর্টালটিতে আমার কোনও বিনিয়োগ নেই।' ছাত্রলীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা জানান প্রকাশক হতে প্রায় ৩০/৪০ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন নাজমুল।
ডিলারশিপ
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরপরই সিম্ফনি মোবাইল ফোনের ডিলারশিপ পান নাজমুল। জামালপুর শহরের মেডিক্যাল রোডের বিউটি প্লাজায় দোকানটি অবস্থিত। নাজমুলের ভাই আদনান সিদ্দিকী দাবি করেন এই ডিলারশিপ তার। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, 'আমার ভাই ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার দু মাস আগে আমি এই ব্যবসা শুরু করি। ডিলারশিপ পেতে নাজমুল ভাই আমাকে কোনও সহায়তা করেননি। আমি আমার কোনও ব্যবসায় তার সহায়তা নেই না।'
এ বিষয়ে নাজমুল বলেন, 'ডিলারশিপের জন্য আবেদন করার সময় পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী মির্জা আজম ও আমার নাম রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছিল আমার ভাই। এরপর সে ডিলারশিপ পায়। তবে আমি রাজনৈতিকভাবে কোনও প্রভাব খাটাইনি। যে কোনও ব্যক্তি কোম্পানির শর্ত পূরণ করে ডিলারশিপ পেতে পারে। এ জন্য রাজনৈতিক প্রভাবের কোনও দরকার নেই।'
তবে সিম্ফনির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে নাজমুল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরই ওই ডিলারশিপ দেওয়া হয়েছিল।
এছাড়া নাজমুল তার চাচাকে একটি মোটরবাইক কোম্পানির ডিলারশিপ নিয়ে দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে তার চাচা আশরুফল আলম বলেন, 'তিন মাস আগে আমি কোম্পানির ডিলারশিপ পাই। এ জন্য আমি নাজমুলের কাছ থেকে কোনও সহায়তা নেইনি।'
সরকারি প্লট
জানা গেছে ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম উভয়েই পূর্বাচল নিউ টাউন প্রজেক্টের পাঁচ কাঠা করে প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। নাজমুল বলেন, 'অনেকদিন আগেই আমরা আবেদন করে রেখেছিলাম। সব ধরনের নিয়ম মেনেই প্লট বরাদ্দ পেয়েছি।' পূর্বাচলের প্রকল্প পরিচালক আনোয়ার হোসেন জানান, সরকারি সংরক্ষিত কোটায় তারা প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন।
আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স
দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স আছে নাজমুলের। 'রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি' হিসেবে ওই দুটি অস্ত্র লাইসেন্স করেছেন তিনি। এর মধ্যে একটি শটগান, আরেকটি পিস্তল। নাজমুল বলেন সব ধরনের শর্ত পূরণ করেই আমি এ লাইসেন্স করিয়েছি।'
শহরে বাড়ি
স্থানীয়রা জানান গত বছর জামালপুরের মাদ্রাসা রোডে আরেকটি বাড়ি কিনেছেন নাজমুল। টিক্কাপট্টি সেন্ট্রাল পোস্ট অফিসের পেছনেই ওই বাড়ি। তবে বাড়িটির নিবন্ধন রয়েছে তার চাচার নামে। এ বিষয়ে নাজমুল বলেন, 'ওই বাড়ির মালিক আমি নই। চাচা যখন বাড়িটি কিনেন তখন আমি তাকে কিছু টাকা ধার দিয়েছিলাম।'
তিনি বলেন, 'আমি এমপি মন্ত্রী নই। অবৈধ টাকা আয় করি না। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগ আমার কিছু খরচ বহন করে। মাঝে মাঝে সংগঠনের সাবেক নেতারা সহায়তা করেন। তবে আমি প্রধানত আর্থিক সহযোগিতা পাই আমার পরিবার থেকেই।'
নতুন গাড়ি
বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা জানিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরই টয়োটা এলিয়ন গাড়ি ব্যবহার করছেন নাজমুল। ওই গাড়িটি লেকচার পাবলিকেশন নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে নিবন্ধন করা। সূত্র জানিয়েছে লেকচার পাবলিকেশন্সের কাছ থেকে নাজমুল ওই গাড়িটি নেন এই শর্তে যে তিনি নিশ্চিত করবেন ছাত্রলীগের কেউ তাদের ব্যবসার পথে বাধা হবে না। লেকচার পাবলিকেশনের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, 'গাড়িটির বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনারা কোম্পানীর চীফ অপারেটিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলুন।' তবে তিনি বলেন, 'যতদূর আমি জানি গাড়িটি নাজমুলের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।'
নাজমুল এই প্রতিবেদককে ফোন করে বলেন, 'আমি শুনেছি আপনি আমার গাড়ির মালিককে ফোন করেছিলেন। আপনি যদি আমাকে কল দিতেন আমি আমার সকল সম্পত্তি সম্পর্কে আপনাকে বলতাম। আমার সম্পর্কে জানতে অন্য মানুষকে ফোন দেওয়ার প্রয়োজন নেই।' তিনি জানান লেকচার পাবলিকেশনের চেয়ারম্যানের ছেলে মেহেদি হাসান তার বন্ধু। নাজমুল বলেন, আমরা একটি সমাজে বসবাস করি। এমন কিছু লিখবেন না যাতে আমার সম্মানহানি হয়।
ফেসবুকে নাজমুলের প্রতিক্রিয়া
"আমাকে জড়িয়ে 'ঢাকা ট্রিবিউন' সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ প্রসঙ্গে
ঢাকা ট্রিবিউনের অনলাইন ভার্সনের প্রধান শিরোণামে আমার চোখ আটকে গেলো। শিরোণাম পড়ার আগেই ব্যঙ্গ কার্টুনে আমার চোখ পড়লো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হলাম। একি! আমাকেই আমি দেখছি ওই ব্যঙ্গ কার্টুনে। আমার হাতে অস্ত্র, বসে আছি একটা গাড়িতে। পিছনে বিল্ডিং, মার্কেট, হুন্ডা, প্লট, রাস্তা; সবখানে লেখা bcl প্রপার্টিজ, bcl হোন্ডা, bcl ডিলারস আরও অনেক কিছু।
কার্টুন হিসেবে যে ছবিটি দেওয়া হয়েছে তা দেখে আমি স্তম্ভিত দুটি কারণে। প্রথমত, ছবিটিতে আমাকে যতোটা অবমূল্যায়ন করা হয়েছে তার চেয়ে বেশী অবমূল্যায়ন করা হয়েছে ছাত্রলীগকে। দ্বিতীয়ত, এ কার্টুনের ভেতরে আমি অন্যরকম এক ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি। বিষয়টা একটু বিষদভাবে বলছি -
এদেশের তথাকথিত একদল বুদ্ধিজীবী চায় এদেশে ছাত্ররাজনীতি না থাকুক। ওয়ান ইলেভেনের সময়ও এ ধরণের প্রবনতা লক্ষ্য করা গেছে। ঢাকা ট্রিবিউন এর এ নিউজ দেখে আমার মনে হয়েছে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার এজেন্ডা নিয়ে নিউজটি ছাপানো হয়েছে। আর একথা সকলেই জানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে এর সুফল কে বা কারা ভোগ করবে বা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি কি হবে।
আমি স্পষ্টভাবে বলছি - ছাত্রলীগ আমার একার সংগঠন না, ছাত্রলীগ লাখো লাখো ছাত্র-ছাত্রীর প্রাণের সংগঠন। আমি ক্ষমতার লোভে ছাত্রলীগ করি না, ছাত্রলীগ করি হৃদয়ের টানে। ছাত্রলীগ তো আমার ও আমাদের প্রাণের স্পন্দন।
এবার আসি অস্ত্র প্রসঙ্গে। আমি ছাত্রলীগ করি স্কুল জীবন থেকে। স্কুল থেকেই আমি ছাত্রলীগ করতে গিয়ে কোন আপোষ করিনি। যেখানেই জামাত- শিবিরের অপ-কার্যক্রম দেখেছি; সেখানেই সাধ্যমতো প্রতিরোধ করেছি। আর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের সেই উত্তাল দিনগুলিতে আমার ভূমিকা কি ছিলো তা নিশ্চয়ই কারো ভুলে যাওয়ার কথা না। আমার এসকল ভূমিকার কারণে জামায়াত শিবিরের চরম শত্রু আমি। আমাকে নানাভাবে হুমকি দিয়েছে তারা। তাই, বেঁচে থাকার জন্য অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছি। প্রশ্ন হলো- এ নিয়ে যদি নিউজ হয় তাহলে কি ভেবে নেবো আমার প্রিয় গুটিকয়েক সাংবাদিক বন্ধু মনে মনে আমার মৃত্যু কামনা করে!
আমার থাকার বাসা নিয়ে বলা হয়েছে। ভাড়া দিয়ে বাসায় থাকলে সেটা কিভাবে নিউজ হয়? ভাড়া না দিয়ে কোন বাসা দখল করে থাকলে সেটা নিউজ হতে পারতো। আমার গ্রামের বাড়িটি নিয়েও নিউজ হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলি - বাড়িটির কাজ শুরু করে আমার বাবা ১৯৯২ সালে। কি এক বিচিত্র কারণে বাড়িটি তিনি দীর্ঘসময় ধরে করেন। বাড়িটির কাজ শেষ হয় ২০১০ সালে। এরপর, বাড়িতে রঙ করা হয়। আমি অবাক হয়ে ভাবি, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে কি এমন পাপ করেছি যে আমার বাবার তৈরী করা বাড়ি নিয়েও আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে! কি আশ্চর্য মানুষের মন!
আমার ছোটভাইয়ের জামালপুর এর ছোট একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়েও বাজে কথা বলা হয়েছে। আমার ছোটভাই জামালপুর এ সিম্ফনি ফোনের ডিলার। সারাদেশে এ কোম্পানি জেলা -উপজেলা পর্যায়ে ডিলারশীপ দিয়ে থাকে। আমার ভাই ঐ কোম্পানির সকল শর্ত পূরণ করে এ ডিলারশীপ পেয়েছে। এখানে আমার কোন ভুমিকা নাই, থাকার প্রশ্নও আসেনা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের মূল শর্ত পূরণকারীদেরকে এ ধরণের ডিলারশীপ দিয়ে থাকেন।
কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। মনটা সকাল থেকেই বিষন্ন। এ পৃথিবীতে বিষন্নতা বাড়ানোর মতো অনেক কিছুই আছে অথচ বিষন্নতাবিরোধী কোন ক্যাপসুল নাই। সময়ই মানুষের বড় শত্রু, সময়ই মানুষের বড় বন্ধু। সবকিছু সময়ের উপর ছেড়ে দিলাম।
পরিশেষে একটি কথাই বলবো;
প্রভু ওদের সুমতি দাও”
বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত... সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৪

No comments

Powered by Blogger.