মানুষ কেন আইন হাতে তুলে নিচ্ছে? by ইমরান আহম্মেদ

মো. সামিউল আলম ওরফে রাজন (১৩) (বায়ে) ও কিশোর
শামছুদ্দিন মিলন (ডানে)। চুরির অভিযোগে সামিউলকে পিটিয়ে
ও ডাকাত সন্দেহে মিলনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা।
ঘটনা ১.
সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডে গত বুধবার শেখ মো. সামিউল আলম ওরফে রাজন (১৩) নামের সবজিবিক্রেতা কিশোরকে চোর অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় সামিউলকে নির্যাতনকারীরা তাকে পেটানোর দৃশ্যের ভিডিওচিত্র ধারণ করেন। সামিউলকে নির্যাতন করার ২৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের ভিডিওচিত্রে সামিউলের আর্তচিৎকার আর  নির্যাতনকারীদের মুখে অট্টহাসিসহ নানা কটূক্তি শোনা যায়। পিটিয়ে হত্যার পর মাইক্রোবাসে করে লাশ গুম করার চেষ্টা করা হয়।
ঘটনা ২.
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গত শনিবার মুঠোফোন চুরির অভিযোগে নাঈম আহম্মেদ (১৮) নামের এক তরুণকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে নাঈমের মাকেও হত্যাকারীদের মারধরের শিকার হতে হয়।
ঘটনা ৩.
বরিশালের হিজলা উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামে গতকাল রোববার দিবাগত রাত সোয়া দুইটার দিকে ডাকাত সন্দেহে হানিফ সরদার (২৫), মো. হারুন ব্যাপারী (২৩) ও মিরাজ মোল্লা (২২) নামের তিন ব্যক্তিকে পিটুনি দিয়ে হত্যা করে গ্রামবাসী।
চোর বা ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে এমন হত্যার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সন্দেহভাজন আসামিকে ধরে মানুষ আইনের হাতে তুলে না দিয়ে বরং নিজেই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। কিন্তু মানুষ এভাবে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে কেন?
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের দেশের সংবিধান ও প্রচলিত  অাইন অনুযায়ী, প্রত্যেকটি মানুষেরই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সে চোরই হোক বা ডাকাতই হোক। বিচার ছাড়া প্রাণহানি একটি গর্হিত অপরাধ। কিন্তু প্রচলিত বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা চলে যাওয়ার কারণে এমনটা ঘটছে।
এভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়া বিষয়ে তিনি আরও বলেন, মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে, আইন হাতে তুলে নিলেও তাঁকে শাস্তি পেতে হবে না। দেখা যায়, এসব হত্যা মামলার আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর মামলার বাদীকে আবার তারা মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। সাধারণত দুই শ্রেণির লোক এ ধরনের অপরাধে জড়িত হয়। প্রথমত, সংঘবদ্ধ শ্রেণি আর দ্বিতীয়ত যাঁদের বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
২০১১ সালের ৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে আমিন বাজারের বড়দেশী গ্রামসংলগ্ন কেবলার চরে ঢাকার ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সেই হত্যা মামলার ঘটনার কয়েকজন গ্রেপ্তার করা হলেও বিচার এখনো চলছে।
মানুষের এভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, মোটাদাগে বলতে গেলে এখন আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমে গেছে। আইনের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগের প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ।
সন্দেহভাজন আসামিকে ধরে তাকে পুলিশে না দিয়ে আইন হাতে তুলে নেওয়ার কারণ সম্পর্কে নজরুল ইসলাম আরও বলেন, পুলিশ টাকা খেয়ে আসামি ছেড়ে দেয় বলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ধারণা রয়েছে। এ কারণেও এমনটা হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
২০১১ সালের ৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে আমিন বাজারের
বড়দেশী গ্রামসংলগ্ন কেবলার চরে ঢাকার এই ছয়
ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ছবিটি সংগৃহীত।
২০১১ সালের ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের টেকেরহাট মোড়ে পুলিশের সহায়তায় শামছুদ্দিন মিলন নামের এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মিলনকে আটকের পর পুলিশ গাড়ি থেকে তাকে নামিয়ে দেয়। এরপর গণপিটুনিতে মিলন নিহত হয়। সেই ঘটনায় জেলা পুলিশের করা প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের এ হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করছে বলে উল্লেখ করা হলেও মিলন হত্যার বিচারকাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, মানুষের মাঝে এক ধরনের আদিম বর্বরতা রয়েছে। মানুষ সুযোগ পেলেই সেই বর্বর আচরণ করতে চায়। ধর্ম, আইন আর সমাজের মাধ্যমে মানুষের সেই বর্বরতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মানুষের অপরাধের প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আইনের শাসন। কিন্তু এখন দেখা যায়, কোন দলের লোক খুন হয়েছে, সেটি দেখে বিচার হয়। মানুষকে আইনের নামে নানা ধরনের হয়রানি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
নজরুল ইসলাম আরও বলেন, মানুষ আইনের মূল চেতনা থেকে সরে আসছে। মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকাশের পরিবেশটা নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষের মধ্যে আইনের ভয় নেই বললেই চলে। মানুষের মধ্যে শুধু রাজনৈতিকভাবে কে কী বলল, তাঁকে কীভাবে হেয় করা যায়, এমন প্রবণতাই রয়েছে। এ কারণেই মানুষ নিজে নিজে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.