মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের নেপথ্যে by শাহনেওয়াজ

বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের মধ্যে প্রস্তাবিত সীমান্ত সহযোগিতা নিয়ে সমঝোতা স্মারক চুক্তি না হওয়ার ফলে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়েছে। সর্বশেষ মিয়ানমারের বিজিপি বাংলাদেশের বিজিবির নায়েক আবদুর রাজ্জাককে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকার ফলে বাড়ছে চোরাচালান, মানবপাচারসহ নানা ধরনের অপরাধ। এই তথ্য খোদ সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্রের।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমান্ত সহযোগিতা নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক চুক্তির জন্য উপস্থাপন করা হয়েছিল গত বছর। এই স্মারকের চুক্তি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা থেকে ১০টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কাছে মতামত চাওয়া হয়েছিল। কথা ছিল মতামতের ভিত্তিতে সমঝোতা স্মারক চুক্তি হবে। কিন্তু এই কার্যক্রম আর বেশি দূর এগোয়নি। যার ফলে সম্প্রতি মিয়ানমারের বিজিপির হাতে অপহরণ হয়েছে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নায়েক আবদুর রাজ্জাক। তাকে দ্রুত ফেরত আনার ব্যাপারে আশ্বাসও মেলেনি। তবে কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। রাজ্জাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেশটির জলসীমায় অনুপ্রবেশ করেছিল। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে প্রবেশের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে মিয়ানমারের জলসীমায় রাজ্জাকের অনুপ্রবেশ অভিযোগ ঠিক নয়। গত বুধবার ধরে বিজিবির ৬ সদস্যের একটি দল নায়েক আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে নাফ নদীতে টহল দিচ্ছিল। তারা বাংলাদেশের জলসীমায় মাদক চোরাচালান সন্দেহে ২টি নৌকায় তল্লাশি করছিল। এ সময় মিয়ানমারের ক্যাম্পের বিজিপি সদস্যরা একটি ট্রলারে করে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে। এক পর্যায়ে বিজিপি সদস্যদের বহনকারী ট্রলারটি বিজিবির টহল নৌযানের কাছে এসে থামে। বিজিপির ট্রলারটি বাংলাদেশের জলসীমা ছেড়ে যেতে বলা হলে তারা জোর করে নায়েক রাজ্জাককে ট্রলারে তুলে নেয়। বিজিবির অন্য সদস্যরা এতে বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হিয়। পরে বিজিপির ট্রলারটি রাজ্জাককে নিয়ে মিয়ানমার চলে যায়।
কী আছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্ত সহযোগিতা সমঝোতা স্মারকে:
স্মারকে প্রথমেই বলা আছে বর্ডারে লিয়াজোঁ অফিস স্থাপনের কথা। যে লিয়াজোঁ অফিসের মাধ্যমে সীমান্তের সব সমস্যা দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে। এর পাশাপাশি সন্ত্রাসী কার্যক্রম, মাদক পাচার, মানব পাচার, অস্ত্র পাচার, অর্থ পাচার, সাইবার অপরাধ থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধ পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হবে। লিয়াজোঁ অফিসে লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগ করা হবে। দুই পক্ষের সুবিধার্থে যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সীমান্তের টহল জোরদার, নিরাপত্তা জোরদার, সীমান্তে অবৈধ কার্যক্রম নিয়ে সময় অনুসারে বৈঠক হবে। সমঝোতা স্মারকে দু’দেশের যাত্রীদের চলাচলের ক্ষেত্রে একটি আতিথেয়তার পরিবেশ তৈরি করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সমঝোতা স্মারকে চুক্তিটি ৫ বছর মেয়াদের জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই সমঝোতা স্মারক চুক্তিটি আর হয়নি।
জানা গেছে, দু’দেশের মধ্যে মানব পাচার থেকে শুরু করে সব ধরনের অবৈধ কার্যক্রম তদারকির জন্য উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে ২০১৪ সালে ১২ জুন বর্ডার লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। শুধু তাই নয়, এই লিয়াজোঁ অফিসে দু’পক্ষের মধ্যে কারা কারা দায়িত্ব পালন করবে সে বিষয়ে একটি খসড়া তালিকা তৈরি করা হয়। তালিকা অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পদমর্যাদার প্রতিনিধি, বিজিবির পরিচালক পদমর্যাদার প্রতিনিধি, এস.বি, সিআইডি, বহিরাগমন বিভাগ, কাস্টম, বন বিভাগসহ কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি থাকার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু লিয়াজোঁ অফিস তো দূরের কথা, লিয়াজোঁ অফিসারও নিয়োগ করা হয়নি।
জানা গেছে, সীমান্তে লিয়াজোঁ অফিসসহ লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগের জন্য ২০১৪ সালে ৩১ আগস্ট ঢাকায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে লিয়াজোঁ অফিসারের দায়িত্ব ও লিয়াজোঁ অফিসের কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। শুধু তাই নয়, দু’দেশের লিয়াজোঁ অফিসার ও লিয়াজোঁ অফিসের কার্যক্রম কিভাবে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায় সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনায় দুটি দেশের প্রতিনিধিরা সম্মত ছিল সীমান্তে চেকপোস্ট বসানোর ক্ষেত্রে। এর পাশাপাশি সীমান্তে টহল দেয়ার ক্ষেত্রে একটি সময় নির্ধারণ করা হয়। সীমান্তে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে তা নিরসনের জন্য দ্রুত বৈঠকের বিষয়টি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে দু’ দেশের মধ্যে কোনো পক্ষ যদি মনে করে বৈঠকের প্রয়োজন রয়েছে তবে তা দু’পক্ষের সম্মতির মাধ্যমে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে বছরে দুই দেশে একবার করে বড় ধরনের বৈঠক হবে। যে বৈঠকে দু’দেশের সমস্যাগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজা হবে।
এদিকে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর না হওয়ার ফলে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের ৪টি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ইয়াবা চোরাচালান ও মাদক পাচারকারীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছে। তবে এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন জানান, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি।

No comments

Powered by Blogger.