দুপুর হতে হতে নির্বাচনটি মারা গেল by এ কে এম জাকারিয়া

বিশ্বরোড দিয়ে এগিয়ে মালিবাগ বাজার ছাড়িয়ে বাঁয়ে নেমে গেছে শহীদ বাকি সড়ক। এই সড়কের বাঁয়ে, মানে পশ্চিমে ঢাকা উত্তরের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড আর ডানে পূর্ব দিকে ঢাকা দক্ষিণের ১ নম্বর ওয়ার্ড। দুই ঢাকার দুই ওয়ার্ডের নির্বাচন কেমন হচ্ছে, তা দেখতে গতকাল সকাল সকালই সেখানে হাজির ছিলাম। বিশ্বের অনেক দেশে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে ঢোকার ও বের হওয়ার সময় ভোটারদের ওপর জরিপ চালানো হয় কার অবস্থা কী সেটা বোঝার জন্য। আমাদের দেশে সে সুযোগ নেই, এখানে সাংবাদিকদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মানে কেউ কোনোভাবে অনিয়ম বা কারচুপি করছে কি না, কাউকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে কি না, সব প্রার্থী সমান সুযোগ পাচ্ছেন কি না, প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো পক্ষপাত করছে কি না—এসব দেখা।
আগের দিন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ভোটে কারচুপির আশঙ্কা নিয়ে। ধারণা করেছিলাম, ঢাকা সিটি নির্বাচনে অন্তত ভোটকেন্দ্র বা বুথ দখল করে ভোট দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে না। তাই তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, নির্বাচনে অন্য কোনোভাবে অনিয়ম হচ্ছে কি না, তা টের পাওয়ার উপায় কী? তিনি বলেছিলেন, সিটি নির্বাচনে একজন ভোটারকে তিনটি ব্যালট দেওয়া হবে এবং একজন ভোটারের ভোট দিতে ৩ থেকে ৫ মিনিট সময় লাগবে। যদি ৩ মিনিটও ধরা হয়, তবে এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০টি ভোট পড়ার কথা। যদি এর চেয়ে বেশি পড়ে, তবে মনে করতে হবে যে কোথাও সমস্যা আছে। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগে এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছি, আর বিরোধী দল-সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্টরা ভোটকেন্দ্রে আছেন কি না বা ভোট নিয়ে তাঁরা কী বলছেন, সেটা জানার চেষ্টা করব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম।
ঢাকা দক্ষিণের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্র খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে যখন পৌঁছাই, তখন সাড়ে নয়টা। ভোটকেন্দ্রের বাইরে তখন জমজমাট দশা। তবে এই উৎসবে সরকারি দলের লোকজনই শামিল আছেন। ভেতরে অবশ্য বুথগুলোতে তেমন ভিড় চোখে পড়ল না। কেন্দ্রের নিচতলায় ১ নম্বর বুথে সকাল ১০টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ৫৫টি। ২ নম্বর বুথে ৫৩টি। প্রতি ঘণ্টায় ২০টি ভোটকে সর্বোচ্চ মানলে বেশি ভোট পড়েছে। দোতলায় মহিলা ভোটারদের দুটি বুথে গিয়েছি, ৪ নম্বর বুথে ভোট পড়েছে ৪৪টি এবং ৫ নম্বর বুথে ২৫টি। চারটি বুথের তিনটিতেই বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মির্জা আব্বাসের এজেন্ট পাওয়া গেল। একটিতে কেন নেই জিজ্ঞেস করতেই অন্য সব এজেন্ট বলে উঠলেন, ‘আমরা কী করে বলব?’ সব এজেন্ট গলায় প্রার্থীদের প্রতীকের ব্যাজ ঝুলিয়েছেন, কিন্তু মির্জা আব্বাসের এজেন্টের গলায় নেই। এক এজেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাজ কই? তিনি বললেন, ‘ভাই, বুঝেনই তো অবস্থা।’ তবে ভোট ঠিকমতোই হচ্ছে বলে জানালেন মির্জা আব্বাসের এই তিন এজেন্টের সবাই।
খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের পাশেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও খিলগাঁও গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র। একেবারে পাশাপাশি তিনটি কেন্দ্র। এরশাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি বুথে গিয়েও মির্জা আব্বাসের এজেন্টদের দেখা মিলল। সাড়ে ১০টা নাগাদ সেখানে ভোট পড়েছে একটিতে ৫৫, অন্যটিতে ৪৯।
দক্ষিণ থেকে এবার ঢাকা উত্তরে। ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের নূরবাগ মসজিদ কেন্দ্রে সোয়া ১১টার দিকে ভোটারদের শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট দিতে দেখা গেল। কেন্দ্র ২-এর ২ নম্বর বুথে তখন পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৬১টি। মেয়র পদের প্রার্থীদের নিয়ে এখানে তেমন উত্তেজনা নেই। যত উত্তেজনা আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী সর্দার ফয়সাল বাশার ফুয়াদ ও স্বতন্ত্র বা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মোস্তাক আহমেদের মধ্যে। কেন্দ্র থেকে বের হয়ে তালতলা মোড়ে আসতেই দেখি লোকজনের দৌড়াদৌড়ি, একজনের পিঠ দিয়ে রক্ত ঝরছে। জানা গেল ফুয়াদ-সমর্থিত কর্মীদের হাতে ছুরিকাহত হয়েছেন মোস্তাক-সমর্থক জুয়েল। রাস্তায় তখন জটলা, আশপাশের দোকানপাটের ঝাঁপ নামতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে মোস্তাক-সমর্থিতদের মধ্যে পড়ে চড়-থাপড় খেলেন ফুয়াদের কর্মী দেলোয়ার। এসব থামানোর কেউ নেই, না পুলিশ, না বিডিআর, না র্যাব।
পরে জেনেছি, এই উত্তেজনা এখানেই থামেনি। বেলা দেড়টার দিকে খবর পেলাম আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ফুয়াদ যখন নূরবাগ মসজিদ কেন্দ্র থেকে তালতলা মোড়ের দিকে আসছিলেন, তখন পেছন থেকে তাঁকে ছুরি মারা হয়েছে। খিলগাঁওয়ের খিদমাহ হাসপাতালে তাঁর ক্ষত জোরা দেওয়ার জন্য সেলাই দেওয়া হচ্ছে।
সকালের দিকে ভোটকেন্দ্রগুলোতে যে শান্ত পরিস্থিতি ছিল, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে তা পাল্টাতে থাকে। খিলগাঁও মাটির মসজিদের কাছে চৌধুরীপাড়া প্রাইমারি স্কুল কেন্দ্রে পৌঁছার আগেই কেন্দ্রের ভেতরে একদফা হাঙ্গামা হয়ে গেছে। পৌনে ১২টায় কেন্দ্রে ঢুকে মনে হলো এখানে ভোটের বারোটা বেজেছে। কয়েকটি বুথে ভোট নেওয়া চলছে, তবে ভোটারের সংখ্যা হাতেগোনা। আর দুটি বুথে তখনো ভোট নেওয়া বন্ধ। এ সময় কোথা থেকে এক ব্যক্তি এসে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের ব্যালট পেপারের একটি মুড়ি দেখালেন। বললেন, একটু আগে এই বইয়ের সবগুলো পাতা ছিঁড়ে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ঢোকানো হয়েছে। জানতে চাইলাম, কার পক্ষে সিল মারা হয়েছে? তিনি রেডিও প্রতীকে (আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর প্রতীক) সিল দেওয়া একটি ব্যালট পেপার দেখিয়ে বললেন, এটা তাদের কাজ। পাশের বুথে পাওয়া গেল প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে, অনেকটা হতাশ হয়েই সেখানে বসে আছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের এই কর্মকর্তা। জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন? ‘আমি দেখছি’ বলেই তিনি রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
হাজীপাড়ার ইকরা বাংলাদেশ স্কুল কেন্দ্রে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা পৌনে একটা। এই কেন্দ্রে গোলযোগ ও বুথে ঢুকে সিল মারার অভিযোগের কথা শুনছিলাম চৌধুরীপাড়া প্রাইমারি স্কুল কেন্দ্রে থাকতেই। ভোটকেন্দ্র তখন অনেকটাই ফাঁকা। বুথ ১-এ গিয়ে দেখা গেল এজেন্টরা অলস বসে আছেন, কোনো ভোটার নেই। তখন পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৭৭টি। পাশের ২ নম্বর বুথে তখন দু-তিনজন ভোটার। সেখানে বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী আবুল মেছেরের নির্বাচনী এজেন্ট আসিফ অভিযোগ করলেন, ৩০ মিনিট আগে কিছু লোক জোর করে বুথে ঢুকে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের ব্যালট পেপারের বই নিয়ে ভেতরে গিয়ে সিল মেরে বাক্সে ফেলেছেন। এমন অভিযোগের মুখে পাশে দাঁড়ানো নির্বাচনী কর্মকর্তারা আমতা-আমতা করছিলেন। কত ভোট পড়েছে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ১৩৯টি। কাউন্সিলর পদের ব্যালট পেপারের সিল মেরে যেগুলো বাক্সে ঢোকানো হলো, সেগুলোর কী হবে? তাঁরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন, কোনো জবাব নেই। কেন্দ্রের বাইরে তখন অনেক পুলিশ-বিডিআর, ভোটার বলে তখন আর কেউ নেই। দুপুর হতে হতে নির্বাচনটি যেন মরেই গেল!
আবার ফিরে আসি ঢাকা দক্ষিণের ১ নম্বর ওয়ার্ডে। খিলগাঁও সরকারি কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রেও তখন ভোটারের খরা। মহিলা ভোটারদের ১ নম্বর বুথে বেলা সোয়া একটা পর্যন্ত মোট ভোট পড়েছে ১৩০টি। বুথ ২-এ ভোট পড়েছে ১৪৯টি। খাঁ খাঁ দুটি বুথেই মির্জা আব্বাসের এজেন্টদের পাওয়া গেল। জানালেন ভোট ঠিকমতো হচ্ছে। বিএনপি এই সিটি নির্বাচন বর্জন করেছে, এ খবর আগেই পেয়েছি। এজেন্ট দুজন এর কিছুই জানেন না! মনে হলো রাজনীতির সঙ্গে এ দুই নারী পোলিং এজেন্টের কোনো সম্পর্ক নেই।
সুষ্ঠুভাবে এই নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অনেক শঙ্কা ছিল, কিন্তু এই নির্বাচন অনেক আশাও জাগিয়েছিল। চৌধুরীপাড়া প্রাইমারি স্কুল কেন্দ্রে হাঙ্গামার পর যখন ভোটকেন্দ্র ফাঁকা আর বাইরে মানুষের ভিড়, তখন কে যেন একজন বলছিলেন, ‘সরকার একটা সুযোগ নষ্ট করল। এই ভোটটা ভালো করলে সরকারেরই লাভ হইতো।’
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.