‘ছুমন্তর’ ধোপাজান মুঠোয় বন্দি সুনামগঞ্জ by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

ধোপাজান। সুনামগঞ্জের সদর ও বিশ্বম্ভরপুর দুই উপজেলাজুড়ে বয়ে চলা নদী। সীমান্তঘেঁষা ডলুয়ার ওপারের পাহাড়ের গা বেয়ে এ নদীতে বালু বয়ে আসে। এ বালুই হাজার মানুষের জীবিকার উপায়। ধোপাজান বালুমহাল। কেউ আয় করেন গতর খাটিয়ে কেউবা পুঁজি খাটিয়ে আর তার সঙ্গে জোরও খাটান কেউ কেউ। যেখানে জীবিকা সেখানে আয়ের নানা পথ থাকে। থাকে ফন্দি-ফিকিরও। বালুমহাল ইজারা নিতে তাই আগ্রহীদের কমতি নেই। জোর খাটিয়ে-কৌশলে ইজারা নেয়ারও চেষ্টা চলে। তোফাজ্জল হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী বাংলা ১৪২১ সাল পর্যন্ত তিন বছর ধরে ইজারা নিয়ে টোল আদায় করছিলেন বালু উত্তোলনকারীদের কাছ থেকে। অভিযোগ, বছর গড়িয়ে নতুন বছর এলেও তিনি জোর করে এখনও টোল আদায় করে যাচ্ছেন। তোফাজ্জলকে জোর খাটানোর জোর জুগিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ধারী একটি মহল। বিনিময়ে তিনি তাদের ‘খোশ’ রাখছেন নগদ নারায়ণ দিয়ে। যার জোগান আসছে ধোপাজান বালুমহাল থেকেই। তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে এমন  বোঝাপড়ার কারণে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব থেকে।
ধোপাজান বালুমহাল আয়ের এক বিশাল ক্ষেত্র। প্রতিদিন এখানে খাটেন ৫০ হাজার শ্রমিক। প্রায় দুই শ’ কার্গো, আড়াই শ’ ভলকেট (বাল্কহেড) আর ২০ হাজার বারকি নৌকার আনাগোনায় ব্যস্ত থাকে ধোপাজান নদী। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ধোপাজান বালুমহাল থেকে একদিনে যা আয় হয় ‘ক্ষমতার জোরে’ এর চেয়েও কম টাকায় ইজারা নিয়ে ১৪১৯ বঙ্গাব্দ থেকে মহালটি ভোগ করে আসছেন তোফাজ্জল। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ধোপাজান বালুমহাল থেকে দৈনিক ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা আয় করলেও জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে গত দুই বছরে (১৪১৯ ও ১৪২০ বঙ্গাব্দ) এ মহাল থেকে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে মাত্র ২১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। ১৪২১ বঙ্গাব্দেও জমার অঙ্কে তেমন হেরফের হয়নি। ১৪২১ বঙ্গাব্দে জমা হয়েছে ১০ লাখ ২৮ হাজার- যা ভ্যাট ও উৎস করসহ দাঁড়িয়েছিল ১২ লাখ ৩৪ হাজার ২শ’।
তোফাজ্জল হক ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে ধোপাজানের দখল ধরে রাখলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই বলছেন, ধোপাজান বালুমহাল এতো কম টাকায় ইজারা দেয়া মোটেই উচিত হয়নি। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও সদর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম সম্প্রতি সুনামগঞ্জ জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির এক সভায় ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, তাকে দিলেও তিনি ধোপাজানের জন্য বছরে দুই কোটি টাকা দিতে প্রস্তুত আছেন।
তোফাজ্জল ধোপাজান বালুমহালটি প্রথম ইজারা পান ১৪১৯ সালে। পরের বছরও তার কাছেই ইজারা থাকে। আরও ইজারা চান তিনি। মেয়াদ শেষে প্রশাসনের কাছে ইজারা দাবি করেন একসঙ্গে তিন বছরের জন্য। কিন্তু ‘বালুমহাল ও মাটি বিধিমালা ২০১১’ অনুসারে কোন বালুমহাল তিন বছর মেয়াদে ইজারা দেয়ার বিধান নেই। তোফাজ্জল ২০১৪ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট করেন (নং ১২৯৯)। ধোপাজান বালুমহালটি ইজারা চান ১৪২১ থেকে ১৪২৩ সাল পর্যন্ত। বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি মো. হাবিবুল গণির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ তোফাজ্জল হোসেনের কাছ থেকে শুধু ১৪২১ সালের জন্য খাজনা গ্রহণের নির্দেশ দেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসনকে। মন ভরে না তোফাজ্জল হোসেনের। বালুমহাল ইজারা সংক্রান্ত বিধিবিধান জানা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের ২০শে এপ্রিল ইজারার মেয়াদ ১৪২১ থেকে ১৪২৩ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করার জন্য সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করে বসেন। সুচতুর তোফাজ্জল ভালই বুঝতে পারেন জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত তার অনুকূলে যাবে না। তাই দ্রুতই তিনি উচ্চ আদলতে আরও একটি রিট করে একই প্রার্থনা করেন (নং ৫৪৫৯)। সে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৭ই জুন সপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি জাফর আহমদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ তিন বছরের ইজারা বিষয়ে কোন আদেশ না দিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে তোফাজ্জল হোসেনের ২০১৪ সালের ২০শে এপ্রিলের আবেদনের নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে রিটের পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের প্রতি স্থিতাবস্থা জারি করেন। তবে পূর্বের রিটের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ধোপাজান বালুমহাল থেকে টোল আদায় করতে থাকেন তোফাজ্জল। চলতি বছরের ২৩শে ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দেবজিৎ সিংহ ঢাকার সলিসিটর উইংয়ে একটি চিঠি দেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বালুমহাল ও মাটি বিধিমালা ২০১১’ অনুসারে কোন বালুমহাল তিন বছর মেয়াদে লিজ চুক্তি সম্পাদনের কোন বিধান নেই। তাই উচ্চ আদালতের জারিকৃত স্থিতাবস্থা প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এদিকে শেষ হয়ে যায় ১৪২১ সালও। কিন্তু এরপরও জোর করেই টোল আদায় করে চলেছেন তোফাজ্জল। এ ক্ষেত্রে আদালতের ‘স্থিতাবস্থা’কে কৌশলে নিজের পক্ষে উপস্থাপন করছেন। যদিও এরই মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে মো. আফতাব মিয়ার লিভ টু আপিল (নং: ৯৭৫)-এর পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক গত ১৬ই এপ্রিল হাইকোর্ট ডিভিশনের স্থিতাবস্থার আদেশ স্থগিত করেছেন ।
জোর-জবরদস্তিতে তোফাজ্জল হোসেনকে ভরসা যোগাচ্ছেন ‘আওয়ামী লীগ নেতা’ পরিচয়ধারী জনৈক জিয়াউল হক। অদৃশ্য এক খুঁটির জোরে সুনামগঞ্জজুড়ে প্রভাব বিস্তারকারী জিয়াউল হকই তোফাজ্জলকে আশ্রয় দিচ্ছেন। আর তাদের দাপট ধোপাজান পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো সুনামগঞ্জেই। কারণ ‘টাকার খনি’ ধোপাজানের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকে তার হাতে বাঁধা পড়ে সুনামগঞ্জের রাজনীতি-পুলিশ প্রশাসনসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। ধোপাজানের মন্ত্রে বশ করা যায় সবকিছুই। তাই যে কোন কৌশলে-উপায়ে বালুমহালের দখল ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর তারা। বিরুদ্ধ বাতাসেও যাতে ধোপাজানের দখল ছাড়তে না হয় সে ব্যবস্থাও রয়েছে তাদের। বালুমহালের পথে পথে রয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয়। ‘নিরাপত্তা’ দেখভালের জন্য রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। সে বাহিনীতে রয়েছে সুনামগঞ্জজুড়ে আতঙ্ক জাগানিয়া মুখগুলোরই আনাগোনা। তাই সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে টোল আদায় করলেও কেউই প্রতিবাদের সাহস পান না।

No comments

Powered by Blogger.