‘জিতব বিএনপি, নিব আওয়ামী লীগ’ by প্রতীক বর্ধন

সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে মগবাজার ওয়্যারলেস মোড়ের নজরুল শিক্ষালয়ে ভোটারদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি দেখে সেই পুরোনো প্রবাদের কথাই মনে পড়েছিল, ‘মর্নিং শোস দ্য ডে’, অর্থাৎ সকাল দেখেই বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। কিন্তু দিন যতই গড়াতে লাগল, ততই এই প্রাচীন প্রবাদটি মিথ্যা প্রমাণিত হতে লাগল। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে যখন বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিল, তখন সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটল। ২৯ এপ্রিল সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো, তার সারসংক্ষেপ করলে এমনটাই দাঁড়ায়। নজরুল শিক্ষালয় থেকে বেরিয়ে মধুবাগ শেরেবাংলা স্কুলে গিয়েও দেখি বেশ ভালোই জটলা। প্রচুর মানুষ ভোটকেন্দ্রে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। আবারও আশ্বস্ত হলাম, যাক নির্বাচন হচ্ছে। কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা লাগল, এই দুই কেন্দ্রে বিএনপি-সমর্থিত মেয়র বা কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের কাউকেই দেখা গেল না। এমনকি তাঁদের পোস্টারও দেখা গেল না। অথচ দিন দু-এক আগেও সেখানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিএনপি-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পোস্টার দেখা গেছে। প্রচুর তরুণ কর্মীকে দেখা গেল সেখানে, সবার গলায় টেবিল ঘড়ি মার্কার ব্যাজ। প্রচুর মানুষের সমাগম হয়েছে, টেবিল ঘড়ির সমর্থকেরা তাদের ভোটার নম্বর সরবরাহ করছে। বেশ উৎসব উৎসব ভাব। আবার আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকেরা ফাঁকা আওয়াজ দিয়ে নিজেরাই উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। সেই কেন্দ্রের পাশে নয়াটোলা মাদ্রাসা কেন্দ্রেও দেখা গেল, ভোটার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। সেখানেও তাবিথ আউয়ালের কর্মী নেই। দুই কেন্দ্রেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট নেই। তবে কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত স্থানীয় কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের ভিড় দেখা গেল। কেন্দ্রে আসা ভোটারদের তারা বলছে, ‘ভাই, ঘুড়ি (আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর মার্কা) ও ঘড়িতে ভোটটা দিয়েন।’
সেখান থেকে গেলাম পশ্চিম রামপুরার মহানগর আবাসিক প্রকল্প এলাকায়। সেখানকার দুটি ছোট কেন্দ্রের সামনেও টেবিল ঘড়ির সমর্থকদের দেখা মিলল, যথারীতি সেখানও তাবিথ আউয়ালের সমর্থকদের অনুপস্থিতি চোখে পড়ল। তবে ভোট গ্রহণ শান্তিপূর্ণভাবেই অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। কোনো উত্তেজনা চোখে পড়েনি। ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেল, কোনো অনিয়ম হয়নি। তবে ভোটারদের উপস্থিতি খুবই কম। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্টও সেখানে নেই। সেখান থেকে পূর্ব রামপুরা ও উলনে গিয়ে দেখলাম, ভোটারদের সরব উপস্থিতি আছে। উৎসব উৎসব আমেজও আছে। অক্সফোর্ড স্কুল ও পূর্ব রামপুরা হাইস্কুলে তাবিথ আউয়ালের সমর্থকদের দেখা গেল। তারা সেখানে নির্বাচনী ক্যাম্প বসিয়ে ভোটার নম্বর সরবরাহ করছে। সেখানে তাবিথ আউয়ালের কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সেই এলাকার কেন্দ্রে কেন্দ্রে তাঁদের পোলিং এজেন্টরা আছেন, সব ঠিকঠাক চলছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কাজে বাহন হিসেবে সঙ্গে ছিল বাইসাইকেল। রাস্তা ফাঁকা, সাইকেলের এক টানে পূর্ব রামপুরা থেকে চলে এলাম শান্তিনগরে। মালিবাগ মোড় পার হওয়ার পরই খটকা লাগল, রাস্তার দুই ধারে এত বাস কেন? সেখানে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিদ্ধেশ্বরী বালক ও বালিকা বিদ্যালয়, কিডস এরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, লুৎফা একাডেমি প্রভৃতি কেন্দ্রে দেখা গেল, ভোটারদের উপস্থিতি নগণ্য। সেখানে একচেটিয়াভাবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকনের সমর্থকদের ভিড়। যথারীতি সেখানেও বিএনপি-সমর্থিত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসের সমর্থকদের দেখা মিলল না। বিএনপির কর্মীদের অভিযোগ, মির্জা আব্বাসের এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি এবং বহিরাগত আওয়ামী লীগের কর্মীদের কেন্দ্রে ঢুকিয়ে সিল মারানো হয়েছে। আর এটাই নাকি সেই বাসরহস্য! ওই বাসে করেই তাদের আনা হয়েছে।
শান্তিনগরের এক বাসিন্দা অভিযোগ করেন, তিনি কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন তাঁর ভোট আগেই কেউ দিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে রাস্তায় জটলা দেখা গেল, এক শুভ্র কেশের প্রবীণ ব্যক্তি মাছরাঙা টিভিতে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে অভিযোগ করছেন, ‘আমি জাতীয় নির্বাচনে লুৎফা একাডেমিতে ভোট দিয়েছি, অথচ এবার এসে দেখি, সেখানে আমার ভোট নেই। সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভোটারদের হেনস্তা করছে।’ তাঁর কথা শুনে এক ব্যক্তি প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আপনি ভোটার, আপনার দায়িত্ব নিজের ভোটকেন্দ্র খুঁজে বের করা।’ জানা গেল, সেই প্রতিবাদকারী একজন সরকারদলীয় কর্মী। এর মধ্যে খবর এল, বিএনপি তিন সিটি করপোরেশনেরই নির্বাচন বর্জন করেছে।
নির্বাচনের আগের রাতে রিকশায় বাসায় ফেরার সময় চালককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কে জিতবে বলে মনে হচ্ছে? উত্তরে ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘জিতব বিএনপি, নিব আওয়ামী লীগ।’ হ্যাঁ, এবার বিএনপি বলতে পারবে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে তারা ভোটের মধ্যেই নির্বাচন বর্জন করেছে। রাজনীতিতে তারা আসলেই জিতল কি না, তা এখনই হলফ করে বলা যাচ্ছে না। সেটা নির্ভর করছে তাদের ওপরই।
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক ও অনুবাদক।
bardhanprotik@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.