সাংবাদিকদের ওপর হামলা, পুলিশের আচরণও নিন্দনীয়

গত মঙ্গলবার ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ চলাকালে সরকার-সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালিয়ে শুধু গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করেননি, তাঁদের এই দুর্বৃত্তপনার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের অসাধু উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। আমরা হামলাকারীদের প্রতি তীব্র ধিক্কার জানাই এবং তাঁদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করি।
সংবাদমাধ্যম ছিল নির্বাচনের সবচেয়ে কার্যকর পর্যবেক্ষক। স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের ভূমিকা হতে পারত নির্বাচন কমিশনের সহায়ক। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিজেই স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চেয়েছে কি না, তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে; কেননা স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপায়গুলো কমিশন নিশ্চিত করেনি। ভোট গ্রহণ চলাকালে সব ধরনের অন্যায়-অপকর্ম প্রতিরোধের অন্যতম উপায় ছিল সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুযোগ অবারিত রাখা, তাঁদের কাজে বাধা সৃষ্টি করা হলে সেই বাধা দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা তো করেইনি, বরং তার নির্দেশনায় পরিচালিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে বাধা দিয়েছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে নয়জন সাংবাদিকের ওপর শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, ভয় দেখিয়ে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছে আরও ১৫ জনকে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আক্রান্ত বা বাধাপ্রাপ্ত সাংবাদিকদের সহযোগিতায় এগিয়ে না এসে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। পুলিশের এই দলীয় আচরণও নিন্দনীয়।
সাংবাদিকদের ওপর হামলা, ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া ও ভয়ভীতি দেখিয়ে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে ভোট চুরিসহ সব রকমের অন্যায়-অপকর্ম যাতে জনসমক্ষে প্রকাশ না পায়, ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ বাহিনী একযোগে তা-ই চেয়েছে। এ ধরনের প্রবণতা জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে মঙ্গলবার যাঁরা এসব অপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
২১ সাংবাদিক হামলা ও বাধার শিকার
আপডেট: ০৪:২৫, এপ্রিল ২৯, ২০১৫
গতকাল মঙ্গলবার তিন সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণ চালকালে সরকার-সমর্থক নেতা-কর্মীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন সাংবাদিকেরা। যেখানেই সুযোগ পেয়েছে সেখানেই সাংবাদিকদের ওপর হামলা, ক্যামেরা ভাঙচুর ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্রছাড়া করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে এ ঘটনায় অন্তত ছয়জন সাংবাদিকের ওপর হামলা হয়েছে। ভয় দেখিয়ে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছে আরও ১৫ জনকে।
ঢাকার বাসাবো উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন একটি অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিক ইয়াসিন হাসান রাব্বী।
প্রথম আলোর অন্তত আটজন সাংবাদিক হামলা ও বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। সরকার-সমর্থক নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি পুলিশও সাংবাদিকদের বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দিয়েছে। দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন।
রাজধানীর শাহজাহানপুরের মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে গতকাল দুপুরে ভোট চুরির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সুজয় মহাজন। তাঁকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি ও লাথি মারতে থাকে সরকার-সমর্থক মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা। পুলিশ ও কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সামনেই এ ঘটনা ঘটে। হামলাকারীরা তাঁর দুটি মোবাইল ফোন ও পরিচয়পত্র কেড়ে নেয়। পরে পুলিশের সহায়তায় ফোনসেট দুটি উদ্ধার হয়।
জাল ভোট ও সংঘর্ষের ছবি ধারণ করতে গিয়ে হামলায় চট্টগ্রামে চারজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন পূর্বকোণ-এর জ্যেষ্ঠ ফটোসাংবাদিক মিয়া আলতাব, ৭১ টিভির আজাদ তালুকদার ও জহিরুল ইসলাম; আরটিভির পারভেজুর রহমান। হামলাকারীরা তাঁদের দুটি ক্যামেরা ও একটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে।
রাজধানীর বিজয়নগরে মূক ও বধির স্কুল কেন্দ্রের ৪ নম্বর বুথে মির্জা আব্বাসের নির্বাচনী এজেন্টকে বের করে দিয়ে সাঈদ খোকনের পক্ষে মাছ মার্কায় জাল ভোট দেওয়া হচ্ছিল। এই কেন্দ্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি আশীষ-উর-রহমান সেলফোনে জাল ভোট দেওয়ার ছবি তুললে তাঁকে ঘিরে ফেলে সরকার-সমর্থকেরা। এ সময় তিনি প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কক্ষে আশ্রয় নেন। কিন্তু প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তাঁর কক্ষে ছিলেন না। কর্তব্যরত পুলিশ তাঁকে কক্ষ থেকে বের হতে বাধ্য করেন। পুলিশ তাঁকে বলেন ‘এখান থেকে যান। আপনার সমস্যা আপনি সমাধান করেন।’ হামলাকারীরা জোর করে তাঁর ফোন থেকে ছবি মুছে ফেলে। খবর পেয়ে সহকর্মীরা গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেন।
সকাল নয়টার দিকে ওয়ারীর সিলভার ডেল প্রিপারেটরি গার্লস স্কুলের সামনে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শুভংকর কর্মকারকে সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকেরা কেন্দ্র থেকে বের করে দেন ও তাঁর সেলফোন কেড়ে নেন। পরে ফোনটি তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়।
পুরান ঢাকার নারিন্দার দক্ষিণ মৈশুন্ডি ভোটকেন্দ্র দায়িত্ব পালন করার সময় প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মোশতাক আহমেদের ডায়েরি ও টাকা ছিনিয়ে নেয় সরকার-সমর্থকেরা। এ সময় ভয় দেখিয়ে তাঁকে দ্রুত ওই এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
দক্ষিণ সিটি এলাকায় যুগান্তর-এর সাংবাদিক ওবায়েদ অংশুমানকে আহত করে তাঁর ভিডিও ক্যামেরা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয় হামলাকারীরা।
উত্তর সিটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে জামিয়া মোহাম্মদিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে প্রথম আলোর প্রতিবেদক মাহবুবুল হক ভূঁইয়া ব্যালটে সিল মারার দৃশ্য দেখার সময় তাঁকে হুমকি দিয়ে দ্রুত কেন্দ্র ছাড়ার নির্দেশ দেয় সরকার-সমর্থকেরা।
মিরপুরের শাহ আলী মহিলা কলেজ কেন্দ্রে সমকাল পত্রিকার দুই প্রতিবেদক শরিফুল ইসলাম ও যিলফুল মুরাদ এবং প্রথম আলোর প্রতিবেদক সামছুর রহমানকে চলে যেতে হুমকি দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় নারিন্দায় ফকির চান কমিউনিটি সেন্টারে প্রথম আলোর প্রতিবেদক মাসুম আলী, আলোকচিত্রী পাপ্পু ভট্টাচার্য এবং মানবকণ্ঠ পত্রিকার প্রতিবেদক এম মামুন হোসেন ভেতরে ঢুকতে চাইলে সরকার-সমর্থকেরা ধাক্কা দিয়ে তাঁদের বের করে দেয়।
সেগুনবাগিচায় যুগান্তর-এর একজন ফটোসাংবাদিককে যুবলীগের নেতা-কর্মীরা আটকে রাখেন। লালবাগ মডেল স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রে প্রবেশের সময় দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশে বাধা দেন।

No comments

Powered by Blogger.