বালটিমোর জ্বলছে! by হাসান ফেরদৌস

বাল্টিমোরে সহিংস বিক্ষোভের সময় রাস্তায় পুলিশের একটি গাড়ি
ধ্বংস করে তার উপর বিক্ষোভকারীরা আরোহণ করে
গতকাল রাতেও বালটিমোরে কারফিউ ছিল। এক দিন আগে এই শহর ছিল যেন যুদ্ধের ময়দান। একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে কৃষ্ণকায় মার্কিন। একজনের হাতে লাঠি, ঢাল ও বন্দুক; অন্যদের হাতে পাথর ও দেশলাই। চারদিকে আগুনে পুড়ে যাওয়া দোকান, অফিস। এ দৃশ্য আমেরিকার কোনো শহরের, এ কথা ভাবা অসম্ভব—একজন ছাত্রের এই উদ্ধৃতি দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস তার এক দীর্ঘ প্রতিবেদন শেষ করেছে।
বস্তুত, এটাই আমেরিকায়, যা আমাদের চক্ষুর অন্তরালে ছিল, এখন সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে। তার আলোঝকমকে শহুরে জৌলুসের পেছনে যে কালো অন্ধকার, বালটিমোরের ঘটনা তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। একধরনের বর্ণভিত্তিক বিভাজন আমেরিকার অনেক শহরেই রয়েছে। গত তিন বছরে যেখানেই শ্বেতপ্রধান পুলিশ ও কৃষ্ণপ্রধান নাগরিক গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে বর্ণবাদ ও অর্থনৈতিক অসাম্য।
বালটিমোরের কথাই ধরুন। এ শহরের মোট জনসংখ্যা ছয় লাখের সামান্য বেশি, যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আফ্রিকান-আমেরিকান। এই শহরের প্রতি নয়জনের একজন বেকার, তবে সাদাদের তুলনায় কালোদের বেকারত্বের হার দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি। এই শহরের এক-পঞ্চমাংশ নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, আর শুধু কালোদের ধরলে এই সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। এই শহরের কালোদের অসম অর্থনৈতিক অবস্থার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ শিশু মৃত্যুর হার। শ্বেতকায়দের তুলনায় কৃষ্ণকায় শিশু মৃত্যুর হার প্রায় নয় গুণ বেশি। অবস্থাসম্পন্ন শ্বেতকায়দের তুলনায় কৃষ্ণকায়দের আয়ু গড়ে ২২ বছর কম।
আমেরিকার প্রায় সব শহরেই প্রশাসনের মূল নজর থাকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার। এ কথার অর্থই হলো কালোদের ওপর ঢালাও পুলিশি আক্রমণ। কিন্তু পুলিশি নির্যাতনের হিসাবে বালটিমোর সম্ভবত অন্য সব শহরকে ছাড়িয়ে গেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বালটিমোর সান পত্রিকা এক দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কালো মানুষদের প্রতি এই শহরের পুলিশের আচরণের এক অভাবনীয় চিত্র তুলে ধরেছে। শুধু কালো হওয়ার অপরাধে জেলে যেতে হয়েছে, এমন ঘটনা এখানে ঘটছে হরহামেশা। ১১ বছরের বালক থেকে ৮৭ বছর বয়স্ক দাদিমা পুলিশের এই সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা পাননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতি সামান্য আইন অমান্যের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই কোনো কারণ ছাড়াই পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
বালটিমোর সান ৮৭ বছর বয়স্ক ভেনাস গ্রিনের উদাহরণ দিয়েছে। চার বছর আগে নিজের প্রোপুত্র রাস্তায় গুলিতে আহত হয়েছে, সে কথা জানাতে তিনি পুলিশে ফোন করেছিলেন, অথচ পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে বসে। একজন শ্বেতকায় পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গুলির ঘটনা ঘরের ভেতরে ঘটেছে, তিনি ঘরের ভেতরে যাবেন। ভেনাস তল্লাশির আগে পুলিশের কাছে ওয়ারেন্ট চাইলেন, এর জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন এবং হাতকড়া পরান। ‘হারামজাদি, তুই অন্য কালো কুত্তিদের চেয়ে আলাদা কিছু না।’ পুলিশ কর্মকর্তা হাতকড়া লাগাতে লাগাতে এ কথা বলেন।
এ বিষয়ে আদালতে মামলা উঠলে প্রমাণিত হয় যে শ্বেতকায় পুলিশ কর্মকর্তা দোষী। ঝামেলা এড়াতে বালটিমোরের পুলিশ দপ্তর ক্ষতিপূরণ দিয়ে ব্যাপারটি মিটমাট করে। ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত বালটিমোরের পুলিশ তাদের বে-আইনি কাজ ঢাকতে শতাধিক মামলা ক্ষতিপূরণ দিয়ে মিটমাট করেছে। এর জন্য তাদের ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ ডলার।
বালটিমোরে দাঙ্গা শুরু ফ্রেডি গ্রে নামের ২৫ বছর বয়স্ক এক আফ্রিকান-আমেরিকানের গ্রেপ্তার এবং পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কারণে মৃত্যুর ঘটনা থেকে। কী কারণে ফ্রেডিকে গ্রেপ্তার করা হলো? যে তথ্য এখন বেরিয়ে এসেছে, তা থেকে দেখা যাচ্ছে যে ফ্রেডি ও তাঁর এক বন্ধু রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ টহলদার পুলিশ এসে হাজির। পুলিশের ঝামেলা এড়ানোর জন্য এ দেশে কালোরা সাধারণত পুলিশের দিকে সরাসরি তাকায় না। ফ্রেডির অপরাধ, তিনি এক পুলিশ কর্মকর্তার চোখের দিকে সরাসরি তাকান। সাইকেলে পুলিশ তাঁর পিছু নিলে ফ্রেডি পালাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু পালাতে ব্যর্থ হন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর সেখানেই ফ্রেডির মৃত্যু হয়। গ্রেপ্তারের সময় যে ভিডিও পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় যে এক পুলিশ তাঁর গলা চেপে ধরেছেন, আর ফ্রেডি চিৎকার করে বলছেন, ‘থাম, আমার লাগছে।’ এক সপ্তাহ পরে হাসপাতালে ফ্রেডি মারা গেলে দেখা যায় যে তাঁর শিরদাঁড়ার ৮০ শতাংশ গুঁড়িয়ে গেছে। পুলিশ স্বীকার করেছে, গ্রেপ্তারের সময় ফ্রেডির কাছে কোনো বন্দুক ছিল না, ছিল শুধু ছোট একটি সাধারণ ছুরি।
গত বছরের জুলাই মাসে নিউইয়র্কের স্টাটেন আইল্যান্ডে এরিক গার্নার নামের এক ব্যক্তি একইভাবে মারা যান। পুলিশ তাঁর গলা চেপে ধরলে গার্নার হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, ‘থাম, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।’
পুলিশি নির্যাতনের এই দৃশ্য এ দেশের কৃষ্ণকায়দের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। ফ্রেডির মৃত্যু প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওবামা মন্তব্য করেছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা পরিচিত ও পুরোনো ঘটনা। একে লুকিয়ে-ছাপিয়ে রাখা যাবে না। এ ঘটনা অনেক দিন থেকে চলছে, অনেক দিনের সঞ্চিত ক্ষোভ থেকে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বালটিমোরে। ‘এটা মোটেই নতুন নয়, তা নিয়ে অজ্ঞতা প্রকাশের কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
ওবামা বালটিমোরের সহিংসতার নিন্দা করেছেন। যারা লুটপাট করেছে, তারা মোটেই কোনো রাজনৈতিক প্রতিবাদ করছে না, তারা সাদামাটা অপরাধী, ক্রিমিনাল বলে তিনি দাবি করেছেন। সে কথা হয়তো মিথ্যা নয়, কিন্তু এ কথায়ও কোনো ভুল নেই যে বালটিমোরের কৃষ্ণকায় দাঙ্গাকারীদের নিজেদের বৈষম্যের ও পুলিশি নির্যাতনের প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণের এ ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না।
সে কথাটা কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন ফ্রেডি গ্রের আইনজীবী বিলি গ্রে। গত সপ্তাহে ফ্রেডির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সময় তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই এখন ফ্রেডি গ্রের নাম জানি, তাকে চিনি। কিন্তু এই দাঙ্গার আগে তাকে কে চিনত, কে তার নাম জানত?’
সম্ভবত দরিদ্র ও ক্ষমতাহীন কৃষ্ণকায়দের হাতে সহিংসতাই একমাত্র রাজনৈতিক হাতিয়ার। যে বৈষম্য ও অবিচার এ দেশে এখনো বিদ্যমান, তা দূর না হলে সে হাতিয়ারের ব্যবহার ভবিষ্যতে আরও দেখতে হবে, সে কথায় কোনো ভুল নেই।
২৯ এপ্রিল ২০১৫, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরেদৗস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.