মোটা হয়ে যাচ্ছে শহুরে শিশুরা -আইসিডিডিআরবির গবেষণা by শেখ সাবিহা আলম

স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপ ২০১৪ বলছে, গত তিন বছরে পুষ্টি পরিস্থিতির ধারাবাহিক উন্নতি হয়েছে। বেঁটে হয়ে যাওয়া ও রুগ্ণ শিশুর সংখ্যা কমেছে। কিন্তু সরকারের জাতীয় পুষ্টিসেবা কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী ক্রমশ চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে শহুরে শিশুদের মোটা হয়ে যাওয়াটা।
গত ২৪ এপ্রিল প্রকাশিত স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপ ২০১৪-তে বলা হয়েছে, গত তিন বছরে বেঁটে হয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা ৪১ শতাংশ থেকে কমে ৩৬ শতাংশে এসেছে। রুগ্ণ শিশুর সংখ্যাও ১৬ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশে নেমেছে। তবে জাতীয় পুষ্টিসেবা কর্মসূচি আইপিএইচএন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) গবেষণায় দেখা গেছে, মহানগরগুলোতে এখন প্রতি ১০০ শিশুর ১৪টির ওজন বেশি। কমপক্ষে চারজন স্থূল। ‘ওবেসিটি প্রিভালেন্স অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্টস ইন আরবান এরিয়াস ইন বাংলাদেশ’ বাংলাদেশের সাতটি সিটি করপোরেশনের ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৪ হাজার ১০০ শিশুর ওপর জরিপ চালায়। জরিপটির প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ পায় প্রায় দুই বছর আগে। আলাদাভাবে আইসিডিডিআরবি ১৯৯৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা ও মতলব কেন্দ্রের ৪০ হাজার ৩৪৯টি শিশুর ওপর জরিপ চালিয়েও একই ফল দেখতে পেয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশ পায় এ বছরের মার্চে।
গবেষকেরা শিশুদের মুটিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ক্যালরি-সমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়া এবং দৈনিক কমপক্ষে এক ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়ে খেলাধুলা না করাকে দায়ী করেছেন। তাঁরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন দেখা, কম্পিউটার ও মুঠোফোনে ভিডিও গেমস খেলার নেশা শিশুদের জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে।
শিশু, পুষ্টি ও ডায়াবেটিস রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুটিয়ে যাওয়া বা স্থূলতার কারণে শিশুরা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
আইসিডিডিআরবির পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক তাহমিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, কোনো দেশ যখন ক্রমশ অর্থনৈতিক উন্নতির পথে হাঁটে, তখন দেশটিতে বেঁটে হয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা কমে আর মুটিয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা বাড়ে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একই সঙ্গে দুই ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছে। একদিকে আছে অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, অন্যদিকে মুটিয়ে যাওয়া শিশু। বাংলাদেশে স্থূলতার সমস্যা প্রকট হওয়ার আগেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
কত শিশু মোটা, কেন আশঙ্কা: জাতীয় পুষ্টিসেবা কর্মসূচির সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি বাংলাদেশের সাতটি মহানগরে যে গবেষণা চালায়, তাতে দেখা গেছে যে জরিপের অন্তর্ভুক্ত শিশুদের ৯৮ শতাংশ সপ্তাহে কমপক্ষে চারবার শর্করাসমৃদ্ধ খাবার ভাত বা রুটি খেয়েছে। কিন্তু প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ যে পরিমাণে খাওয়া দরকার, তা খাচ্ছে না। পর্যাপ্ত মাংস খেয়েছে ২৪ শতাংশ, ডিম ৬০ শতাংশ, সবজি ৬১ শতাংশ, দুধ ৫৬ শতাংশ আর ফল খেয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ শিশু।
ওই জরিপে আরও যে বিষয়টি উঠে আসে তা হলো, শিশুদের কমপক্ষে ৫০ ভাগ ডুবো তেলে ভাজা শিঙাড়া, সমুচা, চপ, বেগুনি, পেঁয়াজু খেয়েছে। কমপক্ষে ২০ শতাংশ শিশু খেয়েছে পিৎজা, বার্গার ও চিকেন ফ্রাই। ভাত, রুটি, ডুবো তেলে ভাজা খাবার ও ফাস্টফুড অত্যধিক ক্যালরি-সমৃদ্ধ।
চিকিৎসকেরা বলছেন, অগ্ন্যাশয় থেকে বেটা সেল নামের হরমোন বেরিয়ে গ্লুকোজকে ভাঙে। যখন অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার খাওয়া হয়, তখন বেটা সেলগুলো গ্লুকোজকে ভাঙার ক্ষমতা হারায়। ফলে রক্তে শর্করা বেড়ে যায়। এ থেকে শিশুদের ডায়াবেটিস হয়। বারডেম জেনারেল হাসপাতাল পেডিয়াট্রিক এনড্রোকাইনোলজি বিভাগের প্রধান ফৌজিয়া হোসেন নিয়মিত এ ধরনের শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। তিনি জানান, টাইপ টু ডায়াবেটিসের পাশাপাশি অনেক শিশু এখন উচ্চরক্তচাপ ও হৃদ্রোগে ভুগছে। অনেকের যকৃতে চর্বি জমে গেছে। দীর্ঘ মেয়াদে এই শিশুরা লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে।
এ ছাড়া চিকিৎসকেরা আরও বলছেন, শিশুরা কালো হয়ে যাওয়া বা মেয়েশিশুদের দাড়ি-গোঁফ থাকা কিংবা নিয়মিত মাসিক না হওয়ার মতো উপসর্গও দেখা দিচ্ছে। অনেক অভিভাবক বুঝতে পারেন না, এগুলো মুটিয়ে যাওয়ার কারণে হচ্ছে। অনেক শিশু ঘুমের মধ্যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া বা ‘বোবায় ধরা’র কথা বলে। এর পেছনেও মূল কারণ স্থূলতা। এ থেকে একসময় হৃদ্যন্ত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্থূলকায় শিশুদের হৃদ্যন্ত্র শরীরে ঠিকমতো রক্ত সঞ্চালন করতে পারে না। মস্তিষ্কে এক মুহূর্তের জন্য রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
কেন মোটা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, শিশুদের প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়ে খেলতে হবে। শহরাঞ্চলে শিশুরা সেই সুযোগ পাচ্ছে না। ঢাকাজুড়েই মাঠের অভাব। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় মাঠ আছে মাত্র ১১টি। এর মধ্যে আবার সবগুলোতে খেলার সুযোগ নেই। অ্যাপার্টমেন্টেও শিশুদের খেলার জন্য জায়গা নেই বললেই চলে। ফলে শিশুদের একটি বড় অংশ শুধু টিভি দেখে ও ভিডিও গেমস খেলে সময় কাটায়।
রাজধানীর ১০টি বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ুয়া শিশুর অভিভাবকদের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, তাঁদের সন্তানেরা যেসব স্কুলে যাচ্ছে, সেগুলোয় মাঠ নেই, থাকলেও আকারে খুবই ছোট। বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের এক অভিভাবক বলেন, ‘মাঠটি এত ছোট, বল ছুড়লে অধ্যক্ষের কক্ষে গিয়ে পড়বে। ছেলেরা বেঞ্চে বসে “পেন ফাইট” খেলে। ওতে টিফিন হজম হয় না, ভুঁড়ি বাড়ে’।
মনিপুর স্কুলের এক অভিভাবক বলেন, স্কুলের মাঠটি টাইলস দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। শিশুরা স্কুলে একটু খেলার সুযোগ পেত, টাইলস দেওয়ায় এখন হোঁচট খেয়ে পড়ে।
আবার মাঠ থাকলেও কোনো কোনো অভিভাবক শিশুদের খেলতে দিতে রাজি নন। মোহাম্মদপুরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ুয়া সন্তানের মা প্রথম আলোকে বলেন, স্কুলে সুপরিসর মাঠ আছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ খেলাধুলায় উৎসাহ দিলেও অভিভাবকেরা শিশুদের পড়ার সময় নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ করে থাকেন।
চিকিৎসকেরা আমেরিকান জার্নাল অব পেডিয়াট্রিকসের উদাহরণ টেনে বলেন, দুই বছরের নিচে শিশুরা দুই ঘণ্টা পর্যন্ত টিভি দেখতে পারে। দুই বছরের বেশি বয়সীদের টিভি দেখা নিরুৎসাহিত করা উচিত। কিন্তু ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যাসোসিয়েটেড উইথ ওভারওয়েট অ্যান্ড ওবেসিটি অ্যামাং আরবান স্কুল চিলড্রেন অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্টস ইন বালাদেশ: এ কেস কন্ট্রোল স্টাডি’ শীর্ষক গবেষণায় ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও সিদ্ধেশ্বরীর সাতটি খ্যাতনামা স্কুলের শিশুদের ওপর জরিপ চালানো হয়। দেখা গেছে, তারা দিনে চার ঘণ্টা পর্যন্ত টিভি দেখছে।

No comments

Powered by Blogger.