বঞ্চনা ও শোষণের বৃত্তে বন্দি চা শ্রমিকদের জীবন by আবুল কালাম আজাদ

চুনারুঘাটের ২৪টি বাগানের চা শ্রমিকরা ভোটের রাজনীতি আর চা শিল্পে ব্যাপক অবদান রখলেও তাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত নিুমানের। সব কিছুর পরিবর্তন হয় শুধু চা শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই। এখনও তাদের দৈনিক মজুরি ৬৯ টাকা। এ টাকা দিয়ে তিন বেলা আহারের ব্যবস্থা করতে হয়। চা শ্রমিকের সন্তানরা পাচ্ছে না লেখাপড়ার পর্যাপ্ত সুযোগ। স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত রয়েছে তারা। পুষ্টিকর খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবের কারণে দ্রুত নিভে যাচ্ছে তাদের জীবন প্রদীপ। নেই স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান ও পায়খানার সুব্যবস্থা। ডিজিটাল যুগেও আধুনিকতার ছোঁয়া পড়েনি চুনারুঘাটের ২৪ চা বাগানের শ্রমিকের জীবনে। এরা যেন যাযাবর, অভিভাবকহীন, আলাদা জগতের মানুষ। প্রতিবছর ঘটা করে মহান মে দিবস পালন অনুষ্ঠানে তাদের দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস দিলেও তা আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থাকে। মহান মে দিবস উপলক্ষে আজও র‌্যালিতে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। দেশের ১৬৩ চা বাগানের মধ্যে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় রয়েছে ছোট-বড় ২৪টি চা বাগান। এসব বাগানে নিয়োজিত অর্ধ লক্ষাধিক চা শ্রমিক আজও অবহেলিত। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। পূর্ব থেকে গঠিত পঞ্চায়েত কমিটি নামে পরিচিত নেতারা তাদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও উন্নত জীবনের সন্ধান খুঁজে খুঁজে হয়রান চা শ্রমিকরা। প্রতি সপ্তাহে প্রত্যেক শ্রমিককে ১০ টাকা করে পঞ্চায়েত কমিটিকে দিতে হচ্ছে। কিন্তু ওই টাকা কোথায় যায় এর হিসেব কেউ আজও জানে না এমন অভিযোগ রয়েছে শ্রমিকদের। মাঝে মাঝে শ্রমিকদের এসব টাকা নিয়ে বিরোধ বাধে। পুনরায় নেতারা মীমাংসা করে আখের গোছান নিজেদের। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শ্রমিকদের দৈনিক হাজিরা ২৮ টাকা থেকে দুই ধাপে ৬৯ টাকা করা হয়। প্রতিদিন কমপক্ষে একজন চা শ্রমিককে ২৩ কেজি পাতা উত্তোলন করতে হচ্ছে। এখানেও রয়েছে কথিত বাবুদের শোষণ প্রক্রিয়া। ওজন যন্ত্রের মারপ্যাঁচে আটকে যাচ্ছে শ্রমিকদের ২-৩ কেজি পাতা। শ্রমিকদের ভাগ্য নিয়ে ব্রিটিশ প্রথা চালু থাকায় বাগানে ও তার আশপাশে গড়ে উঠেছে শোষক চক্র। এরা নানা কায়দায় শোষণ করছে শ্রমিকদের। সপ্তাহ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে চা শ্রমিকদের মাঝে শোষক চক্র নগদ অর্থ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে পরে কয়েকগুণ বাড়িয়ে নিরীহ চা শ্রমিকদের কাছ থেকে আদায় করে নেয়। শোষণের গ্যাড়াকালের মধ্যেই চলছে চা শ্রমিকদের জীবন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাগানের উন্নয়ন করে যাচ্ছে তারা। তাদের ঘামের ফসল হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। হচ্ছে রাজস্ব আয়। কিন্তু শ্রমিকরা সর্ব ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। পুষ্টিহীনতায় তাদের ছেলে-মেয়েরা প্রায় কংকালসার। তাদের নেই কোনো নিজস্ব ভূমি। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই।
উপজেলায় ছোট-বড় ২৪টি চা বাগানের জনসংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক। এসব চা শ্রমিকের ভাগ্যোন্নয়নে কেউ এগিয়ে আসেনি। তাদের থাকার ঘর জীর্ণশীর্ণ। নেই বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসা সেবা, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট তো নেই-ই। ৬৯ টাকা হাজিরা দিয়ে পুরোদিন চলতে হয় পরিবার নিয়ে। প্রায়ই উত্তেজিত শ্রমিকরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ে কোনো না কোনো বাগানে ধর্মঘট, অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। তারপরও বাগান কর্তৃপক্ষ নজর দেয়নি তাদের ভাগ্য উন্নয়নে।
এ ব্যাপারে শ্রমিক নেতা ও সাবেক ইউপি সদস্য স্বপন সাঁওতাল বলেন, আমরা শ্রমিকরা যুগ যুগ ধরে অবহেলিত। মাত্র ৬৯ টাকা হাজিরায় আমাদের কিছুই হয় না। তিনি বলেন, দুশ’ টাকা হাজিরা করাসহ নানা দাবি তারা পেশ করেছেন। কিন্তু তা কার্যকর করা হচ্ছে না। চা শ্রমিক ইউনিয়নের লস্করপুর ভ্যালির সভাপতি অভিরত বাকতী বলেন, শ্রমিকদের সারা জীবনই বাগান মালিকরা শোষণ করেছেন। তিনি চা শ্রমিক ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা প্রদান, বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট দূর করা এবং অবিলম্বে শ্রমিকদের নতুন ঘর তৈরি করে দেয়ার দাবি জানান। অন্যথায় তারা বৃহত্তর আন্দোলন করবেন বলেও জানান। এ বিষয়ে জনৈক বাগান ব্যবস্থাপক বলেন, শ্রমিকদের ৬৯ টাকা হাজিরা ছাড়াও তাদের চিকিৎসা সেবা, ঘর মেরামত করে দেয়া এবং শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এতে প্রত্যেকের দৈনিক ২শ’ টাকার ওপর মজুরি যাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তাদের অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.