ব্লগার অভিজিৎ-বাবু হত্যা: তদন্তে অগ্রগতি নেই by নুরুজ্জামান লাবু

লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনার দুমাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই। বলা চলে, ক্লু না থাকায় তদন্ত অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। যদিও তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে তারা পরিষ্কার ধারণাও পেয়েছেন। কিন্তু এখনও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কাউকে শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করতে পারেননি। অপরদিকে একই অবস্থা ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডের তদন্তেও। হত্যাকাণ্ডের সময় স্থানীয় লোকজন যে দুই খুনিকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছিল এর বাইরে আর কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের সময় তারা ৫-৬ জন ছিল বলেও স্বীকার করেছিল গ্রেপ্তারকৃত দুই তরুণ। ঘটনার পরপরই তারা পালিয়ে যায়। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। কিন্তু অবস্থান শনাক্ত করা যায়নি। এদিকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার ভারতীয় শাখার সমন্বয়কারী এক ভিডিও বার্তায় ড. অভিজিৎ রায় ও ওয়াশিকুর রহমান বাবুসহ ব্লগারদের হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। যদিও এ দাবির সত্যতা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা থেকে রাত ৯টার দিকে ফেরার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশে দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়। দুর্বৃত্তরা চাপাতি দিয়ে তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকেও কুপিয়ে আহত করে। রাফিদা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও ঘটনাস্থলেই নিহত হন অভিজিৎ রায়। ঘটনাটি সারা দুনিয়ায় আলোচিত হয়। ঘটনার দিনই লন্ডন থেকে করা এক টুইটবার্তায় দায় স্বীকার করে নেয় আনসার বাংলা-৭ নামে একটি সংগঠন। ঘটনা তদন্তে দেশে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা-এফবিআই। অপরদিকে পুলিশের সামনেই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলা নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। তবে ডিএমপির পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি খুঁজে পায়নি। অপরদিেক অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ৩২ দিনের মাথায় গত ৩০শে মার্চ তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ি এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে একই কায়দায় খুন হন আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু। সকালে বাসা থেকে বেড়িয়ে কয়েক গজ হেঁটে যেতে না যেতেই পেছন থেকে চাপাতি দিয়ে হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় বাবুর। আর পালিয়ে যাওয়ার সময় এক হিজড়ার সহায়তায় স্থানীয় লোকজন দুই দুর্বৃত্তকে ধরে ফেলে। গ্রেপ্তারের পর তারা সাংবাদিকদের কাছে আদর্শগত বিরোধের জের ধরেই তাকে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করে। বর্তমানে দুটি ঘটনায় তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ও ডিবির যুগ্ন কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, দুই ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর তদন্তে সহযোগীতার জন্য এফবিআই সদস্যরা এসেছিলেন। তারা তদন্তে প্রযুক্তিগত সহযোগীতা করছে। এছাড়া অভিজিত হত্যাকাণ্ডের কিছু আলামত এফবিআই ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। এসব প্রতিবেদন এখনো আসেনি। তিনি বলেন, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পাঁচের অধিক কয়েকজন সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। তারা সবাই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে জানিয়েছেন তিনি। সাম্প্রতি আল-কায়েদার দায় স্বীকার প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম বলেন, দায় স্বীকারের ভিডিও বার্তাটি আমরা শুনেছি ও দেখেছি। এটি আসলেই আল-কায়েদার কিনা তা আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আল-কায়েদাকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে থাকে। তারা আল-কায়েদার সঙ্গে অর্ন্তভূক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। পুরো বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর গোয়েন্দা পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় একুশে বইমেলা ও টিএসসি এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। তবে ফুটেজে বইমেলাতে একবারের জন্য অভিজিৎকে দেখা গেলেও সেখানে তার পিছু নেয়া কাউকে সনাক্ত করা যায়নি। এছাড়া বইমেলায় অভিজিতের সঙ্গে বুয়েট শিক্ষক ফারসীমসহ যাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল, তাদের সম্পর্কেও গোয়েন্দা নজরদারি করা হয়েছে। এমনকি ফারসীমকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। তবে তাদের কাছে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত কোনও তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। এছাড়া ঘটনার তিন দিনের মাথায় র‌্যাব ফারাবী শফিউর রহমান নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে। সে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। ফারাবীকে গোয়েন্দা পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞসাবাদ করে। কিন্তু ফারাবীও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনও তথ্য দিতে পারেনি। ফারাবীকে জিজ্ঞাসাবাদকারী এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, অভিজিতের হত্যাকাণ্ড সমর্থন করলেও ফারাবী হত্যাকাণ্ডে কারা অংশ নিয়েছিল তা জানাতে পারেনি। সমর্থনের কারণেই প্ররোচনা দিতে বিভিন্ন সময়ে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুনের সমর্থন করে এসেছে সে। গোয়েন্দা সূত্র জানা গেছে, তদন্ত সংশ্লিষ্টরা অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত আলামত ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে হুমকিদাতাদের একটি তালিকা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা-এফবিআইয়ের হাতে দিয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত এসব পরীক্ষার কোনও প্রতিবেদন গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ও ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে অবস্থানকারী চার এফবিআই কর্মকর্তা অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সহযোগিতা করছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা এফবিআই সদস্যরা ফিরে গেলেও ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের এফবিআই সদস্য তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে জানা গেছে। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) আরাফাত বলেন, ঘটনাটি স্পর্শকাতর। অনেক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, তারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) নামে একটি ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠী এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এবিটির একটি স্লিপার সেল সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। ওই সেলের সদস্যদের নাম-পরিচয়ও তারা পেয়েছেন। তবে গ্রেপ্তারের আগে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে তাদের গ্রেপ্তারের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
যোগাযোগ করা হলে অভিজিতের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. অজয় রায় বলেন, পুলিশ তো আমার সঙ্গে যোগাযোগও করে না, তদন্তের অগ্রগতিও আমাকে জানায় না। তবে আমরা আশা ছাড়ছি না। আমার বিশ্বাস পুলিশ চাইলে খুনিদের গ্রেপ্তার করতে পারবে। তবে তাদের ইচ্ছে টা থাকতে হবে। ড. অজয় রায় বলেন, এত বড় একটা ঘটনা পুলিশকে আরো বেশি ত্বরিৎ গতিতে কাজ করা উচিত।
এদিকে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ৩২ দিনের মাথায় একই কায়দায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের দক্ষিণ বেগুনবাড়ি এলাকায় হত্যা করা হয় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতি দিয়ে খুন করে পালিয়ে যাওয়ার সময় জিকরুল্লাহ ও আরিফ নামে দুই তরুণকে ধরে পুলিশে দেয় স্থানীয় লোকজন। গোয়েন্দা পুলিশ এই দুই তরুণকে তিন দফায় ১২ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে জিকরুল্লাহ ও আরিফ জানায়, ঘটনার সময় তাদের সঙ্গে তাহের নামে আরও এক যুবক ছিল। আর মাসুম নামে এক ‘বড় ভাই’য়ের নির্দেশে তারা বাবুকে হত্যা করে। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, গ্রেপ্তারকৃত দুজন নিজেরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করলেও তাদের সহযোগীদের যে নাম বলেছে তা ‘কোড নাম’ বলে তারা ধারণা করছেন। তাদের আসল নাম-পরিচয় উদ্ধার ও গ্রেপ্তারের জন্য চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি পশ্চিম) সাইফুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তারকৃত দুজন আরও যাদের নাম বলেছে তাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে মনে হচ্ছে তারা আসল নাম না বলে ‘কোড নাম’ ব্যবহার করেছে। একারণে অন্যদের খুঁজে পাওয়া একটু দুষ্কর হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.