শিঙ্গেল প্যাঁচার দুটি ছানা by শরীফ খান

ডাকাতিয়া কালবৈশাখী এল মাঝরাতের পরে, চরাচর কাঁপিয়ে-দাপিয়ে চলে গেল ভোরবেলায়। সঙ্গে নিয়ে এসেছিল শিলাবৃষ্টি—এই দুটির সম্মিলনে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলের খেতসহ গাছপালা ভেঙে-উপড়ে পড়ে। উড়ে যায় পাখিদের ঘরবাড়িও, উড়ে যায় উড়তে না শেখা পাখির ছানারাও।
ঝড় যখন চলে গেল, থেমে গেল শিলাবৃষ্টি, তখন বাড়ির আঙিনায় ছেলেপুলেদের হই-হুল্লোড় শুনে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে এলেন মীর ইকরামুল হাসান নামক তরুণ মানুষটি। চারটি শিঙ্গেল প্যাঁচার ছানা নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগিয়েছে ওরা, গত রাতের প্রবল ঝড়ের তোড়ে আঙিনার বয়সী রয়নাগাছ থেকেই পড়েছে ওরা, গাছে বড়সড় খোঁড়ল আছে একটা। ইকরামুল ধমক মারতে মারতে তেড়ে গেলেন ওদের দিকে, ততক্ষণে অপেক্ষাকৃত বড় ছানা দুটির দফারফা হয়ে গেছে। ও দুটিকে হাতে নিয়েই ছেলেপুলেরা দৌড়ে পগার পার। বাকি দুটি ছানাকে দুহাতে তুলে নিয়ে বুকের কাছে আনলেন পাখিপ্রেমী ওই তরুণ। ভয়ে কাঁপছে ওরা থিরথির করে। বুক ঢিপঢিপ। চোখ বুজে আছে ভয়ে।
ইকরামুল ওই সময়েই মুঠোফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানালেন বিস্তারিত, চাইলেন ছানা দুটিকে বাঁচিয়ে রাখার পরামর্শ। ছবি তুলে পাঠালেন। এ ব্যাপারে আমার কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা আছে। ঢাকার ৪০ বছরের জীবনে ঢাকা শহর ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মোট ৭৭ বার লক্ষ্মীপ্যাঁচার ছানাদের খবর আমার কাছে এসেছে, যার অধিকাংশই সদ্য উড়তে শেখা আনাড়ি কিশোর পাখি। হয়তো কাকের কবলে পড়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে, আহত হয়ে ওড়ার শক্তিই হারিয়েছে সাময়িকভাবে, না হয় পড়েছে মানুষের কবলে। সব ক্ষেত্রেই আমি পরামর্শ দিয়েছি শুধু চেলা-পুঁটি-মলা-ঢেলা মাছ খাওয়াতে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দিতে, আর অবশ্যই দিনের বেলায় যথাসম্ভব ঘরের অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় রাখতে। রাতে রাখতে বলেছি খোলা ছাদে, গাছের ডালে। হ্যাঁ, ৭২ বারই সফলতা মিলেছে। কিন্তু ইকরামুল হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি পেয়েছেন শিঙ্গেল প্যাঁচার দুটি ছানা। হ্যাঁ, গত প্রায় চার সপ্তাহে ছানা দুটি পেটপুরে মাছ খেয়েছে, বেড়ে উঠেছে এবং ইকরামুল আশা করছেন আগামী দুই-পাঁচ দিনের ভেতর উড়তে পারবে ওরা। উড়িয়ে দিয়েই ছুটি-শান্তি ইকরামুলের। ঝড়েÿক্ষতিগ্রস্ত হওয়া একটি হলদে বউ পাখির বাসার দুটি ছানা ছেলেপুলেরা নিয়ে যাচ্ছিল, ও দুটিও উদ্ধার করে লালন-পালন করছেন তিনি। আহারে হলুদ রঙের ছানা দুটি!
শিঙ্গেল প্যাঁচারা বাসা করে গাছের খোঁড়লে-কোটরে। ডিম পাড়ে দুই-তিনটি। ছানা হয় ২৫-৩০ দিনে। নিশাচর ও ক্যামোফ্লেজ রঙের। প্রধান খাদ্য গেছো ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর, তক্ষকের ছোট বাচ্চা, লাউডগা সাপের বাচ্চা, ছোট ব্যাঙ ও টুনটুনি জাতীয় ছোট পাখিদের ডিম-ছানা ও পোকা-পতঙ্গ। গেছো ইঁদুরেরা মানুষের লাউ-কুমড়া-শিমসহ গাছফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে। তাই, শিঙ্গেল প্যাঁচারা কৃষকের বন্ধু।
ঘন বন-বাগান, বিশেষ করে বাঁশমহাল বা বাঁশঝাড় ওদের অতি প্রিয় আবাসস্থল। বাঁশ-কঞ্চি ও পাতার রঙের সঙ্গে ওদের রং মিলেমিশে এমনইভাবে ক্যামোফ্লেজ হয়ে যায় যে ওদের দেখতে পাওয়াই দুষ্কর। ওরাও সেটা জানে ভালোভাবে। খুব কাছে গিয়ে ওদের খপ করে ধরে ফেলাও সম্ভব।
ইকরামুল ছানা দুটিকে পান গত ৭ এপ্রিল ভোরে। হলদে বউয়ের ছানা দুটি বাড়িতে আনেন ১১ এপ্রিল। ৬ এপ্রিল দিনগত মাঝরাতের পরই প্রচণ্ড কালবৈশাখী ও শিলাপাতে মাগুরার পাশের জেলা ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ছোট মৌকুড়ি ও পাথরবাড়ে গ্রামের বাঁশঝাড় ও আশপাশের বাগানে আশ্রয় নেওয়া প্রায় পাঁচ হাজার পাখি মারা পড়েছিল, যার অধিকাংশই ছিল শালিক প্রজাতির। ওই ৭ এপ্রিলের ঝড়েই শিঙ্গেল প্যাঁচার ছানা চারটি রয়নাগাছ থেকে পড়েছিল ইকরামুলের বাড়ির আঙিনায়। বাড়িটি মাগুরা শহরেই, পুলিশ সুপারের বাসভবনের পাশেই।
শিঙ্গেল প্যাঁচার ইংরেজি নাম Collared scops owl. বৈজ্ঞানিক নাম otus bakkmoena. এরা নিমপ্যাঁচা নামেও পরিচিত। এই প্যাঁচাদের মাথার দুপাশে দর্শনীয় পালক-শিং আছে। ছাই-বাদামি আর হালকা হলুদাভ রঙের পাখি। পা-ঠোঁটও হলুদাভ। এদের কণ্ঠস্বরটা জোরালো, ডাকটা ভুতুড়ে ভয়ংকর। হুউট-হুট, হুউট! হঠাৎ ডেকে মানুষের পিলে চমকে দেয়। বিখ্যাত বাঘ শিকারি জিম করবেটের ভাষায়, যেন বা কোনো মৃতের আত্মা কবর ফুঁড়ে উঠে এসে দেহটার সন্ধান করছে, বেঁচে ওঠার জন্য করুণভাবে মিনতি জানাচ্ছে কারও কাছে।

No comments

Powered by Blogger.