ধ্বংসস্তূপ থেকে বিনির্মাণ by মার্শা বার্নিকাট

দু্‌ ​ই বছর আগে রানা প্লাজার ভবন ধসের ঘটনা ঘটে, সেই দুর্ঘটনায় চাপা পড়ে মারা যান শ্রমিকেরা, সারা বিশ্বের নজর এসে পড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে। মাত্র একদিনেই বাংলাদেশ হারায় ১১ শর বেশি প্রাণ। আজ আমরা সেই সব শ্রমিককে স্মরণ করছি। তাঁদের পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে এক হয়ে আমরাও শোক পালন করছি। আমরা যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, আমরা সেই বাংলাদেশকে দেখি, যার শ্রমিক ও কর্মকর্তারা এবং সরকার-বিশ্বের বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীদের পাশাপাশি একসঙ্গে কাজ করছেন, যাতে এ রকম ট্র্যাজেডি আর না ঘটে। একসঙ্গে মিলে আমরা উন্নত এবং অধিকতর উৎপাদনশীল তৈরি পোশাকশিল্প খাত গড়ে তুলছি এবং বিশ্বের কাছে তুলে ধরছি-ব্যবসার সফলতা আর শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তা হাতে হাত ধরে চলে।
এ ধরনের কুখ্যাত কারখানা দুর্ঘটনা কেবল যে বাংলাদেশেই ঘটেছে তা নয়। ১৯১১ সালের ২৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ট্রায়াঙ্গেল শার্ট তৈরির কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন ১৪৬ জন শ্রমিক। রানা প্লাজার শ্রমিকদের মতো, ট্রায়াঙ্গেল শার্ট কারখানা দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের মধ্যে ছিল অনেক তরুণী ছিল যাঁরা প্রথমবারের মতো কাজ করে উপার্জন করতে এসেছিলেন। রানা প্লাজার ভবন ধসের ঘটনার মতো ট্রায়াঙ্গেল শার্ট কারখানার আগুনও প্রতিরোধ করা যেত। ওই কারখানার মালিকেরা সিঁড়ি এবং বাইরে বের হয়ে যাওয়ার দরজাগুলো তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিলেন, যার ফলে অনেক শ্রমিকই আগুনে পুড়তে থাকা ভবনটি থেকে বের হয়ে যেতে পারেননি। বরং জীবন বাঁচানোর জন্য নারী শ্রমিকেরা যখন আট, নয় ও দশ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ছিলেন আর মৃত্যুবরণ করছিলেন, তখন প্রত্যক্ষদর্শীদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
এই দুর্ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে, যার মধ্যে রয়েছে- কারখানার নিরাপত্তা-মানদণ্ড উন্নয়নের জন্য এবং আন্তর্জাতিক নারীশ্রমিক ইউনিয়নকে আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন। ফ্রান্সেস পার্কিন্সের নেতৃত্বে জননিরাপত্তাবিষয়ক একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই পার্কিন্সই পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শ্রমমন্ত্রী হন। এই কমিটি সুনির্দিষ্ট সমস্যাগুলো শনাক্ত করে এবং নতুন আইনি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে যার মধ্যে ছিল এক কর্মসপ্তাহে সর্বোচ্চ কাজের সময় কমিয়ে আনার জন্য একটি বিল। কারখানাগুলো সরেজমিনে পরিদর্শনের জন্য মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। নিউইয়র্ক শহরের দমকল বাহিনীর প্রধান জন কেনলন তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেছিলেন যে আগুনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এমন দুই শরও বেশি কারখানা চিহ্নিত করেছে তাঁর বিভাগ।
কারখানার নিরাপত্তা-ত্রুটিগুলো সারিয়ে তুলতে বাংলাদেশেও একই ধরনের পরিবর্তন শুরু হয়েছে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৭ শর -এর বেশি পোশাকশিল্প-কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে, সেগুলোর অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ভবনকাঠামো ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখার জন্য এবং বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় ৩২টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষ শ্রম ও কর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গেলে এ-বিষয়ক সব তথ্য দেখতে পারবে। মন্ত্রণালয় থেকে শতাধিক পরিদর্শক নিয়োগ করা হয়েছে এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই কাজ এখনো শেষ হয়নি; জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ১ হাজারেরও বেশি কারখানা এখন পর্যন্ত পরিদর্শন করা হয়নি। আর যেসব কারখানা নিবন্ধন করা নেই; তাদের অবস্থা এখনো অজানা। বাংলাদেশের এগুলো নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন এবং সব স্টেকহোল্ডারের প্রতি আমাদের অনুরোধ তাঁরা যেন প্রতিটি কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
গুরুত্বপূর্ণ শ্রম অধিকার মানদণ্ড যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের পরিচয় দিতে শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত তিন শর বেশি ইউনিয়ন নিবন্ধিত হয়েছে। একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে, যেখানে গিয়ে ইউনিয়নসমূহ অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারে। এসব ইউনিয়নের সদস্যরা যেন সমষ্টিগতভাবে দর-কষাকষি করার জন্য তাঁদের যে আইনগত অধিকার তা প্রয়োগ করতে পারেন, বহিষ্কার বা হয়রানি হওয়ার ভয় থেকে মুক্ত থাকতে পারেন এবং অবৈধ প্রতিশোধের বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য তাঁদের আইনি অধিকার প্রয়োগ করতে সক্ষম হন-সেসব নিশ্চিত করার জন্য আমরা সরকারকে উৎসাহিত করছি। আমরা শ্রমিক এবং ব্যবস্থাপকদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যেন সংঘাতে রূপ না নেয় সে জন্য তা প্রতিরোধে বিকল্প বিরোধনিষ্পত্তি ব্যবস্থাকেও স্বাগত জানাই। আমরা অপেক্ষা করছি, যেসব নতুন পরিদর্শক আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তাঁরা কারখানা পরিদর্শন করে শ্রম আইনে উল্লিখিত মজুরি ও অন্যান্য বিষয় পর্যবেক্ষণে কাজ করছেন। সে আলোকে শ্রম আইন বাস্তবায়নকারী বিধি জারি করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার মালিকপক্ষকে দ্রুতই একটি উন্নততর দিক-নির্দেশনা দেবে, শ্রমিকদের তাঁদের ভূমিকা বুঝতে সাহায্য করবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেবে যেন সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ হয়।
দুর্ঘটনা থেকে পরিবর্তন শুরু হতে পারে এবং তাই হওয়া উচিত। শ্রমিকেরা, বিশেষ করে প্রথমবারের মতো কাজ করতে আসা হাজারো তরুণ বয়সী নারীকর্মীকে অবশ্যই তাঁদের উদ্বেগের বিষয়গুলো তুলে ধরার অধিকার দিতে হবে, তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে ও নিরাপদ পরিস্থিতিতে কাজ করার অধিকার দিতে হবে। পরিদর্শকেরা যাতে প্রতিটি কারখানা পরিদর্শনের সুযোগ পান এবং সেসব কারখানাগুলোয় যে সমস্যা চিহ্নিত করা হবে সেগুলো সংশোধন নিশ্চিত করা বিজিএমইএ এবং বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব। কারখানার এসব সংস্কার কাজ উৎপাদনশীলতাও বাড়াবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও নারীর ক্ষমতায়নে তৈরি পোশাকশিল্প যে অসামান্য অবদান রেখেছে, তা মাথায় রেখে এই খাতের ২০২১ সালের মধ্যে পাঁচ হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার পরিকল্পনা এই জাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকার, শ্রমিকপক্ষ ও মালিকপক্ষের সঙ্গে অংশীদারত্বের সঙ্গে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বকে দেখাতে চায় যে বাংলাদেশ শ্রমিকের অধিকার ও নিরাপত্তার ব্যাপারে নতুন মানদণ্ড তৈরিতে কাজ করছে, যা নিশ্চিত করবে-আর কোনো শ্রমিককে যেন এ রকম দুর্ঘটনার জন্য ভয় পেতে না হয়।
মার্শা বার্নিকাট, ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত

No comments

Powered by Blogger.