জিতল আ.লীগ, হারল গণতন্ত্র
![]() |
| মির্জা আব্বাস মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রের একটি বুথ। বেলা দেড়টা। ভোটারের অপেক্ষায় দুই নির্বাচনী কর্মকর্তা (ডানে) ও ক্ষমতাসীন দল-সমর্থিত প্রার্থীর প্রতিনিধি (বায়ে) l ছবি: আবদুস সালাম |
তিন
সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঘিরে মানুষের মধ্যে যে শঙ্কা ছিল, শেষ পর্যন্ত
তা-ই সত্যি হলো। প্রশ্নবিদ্ধ এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত তিন মেয়র
প্রার্থী বিজয়ী হলেও গণতন্ত্রের পরাজয় হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে
করছেন।
জাতীয় রাজনীতিতে ঝড় তোলা এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের খেলায় গণতন্ত্র হেরেছে। সরকার-সমর্থকেরা বিরোধীদের বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রের কাছেই যেতে দেননি। অনেকটা ফাঁকা মাঠে পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় উন্মুক্ত কারচুপি করেছেন তাঁরা। আর বিরোধী দল বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীরা ভোট শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। চট্টগ্রামে মনজুর আলম বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার ঘণ্টা খানেক পরই ঢাকায় একই ঘোষণা দেন মির্জা আব্বাসের পক্ষে তাঁর স্ত্রী আফরোজা আব্বাস এবং তাবিথ আউয়াল।
প্রথম আলোর ২৭ জন প্রতিবেদক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১ হাজার ৯৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২৩টি ও ঢাকা দক্ষিণের ৮৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৫৬টি কেন্দ্র ঘুরে এই চিত্র পেয়েছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৭১৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২৭টি কেন্দ্র ঘুরেছেন প্রথম আলোর ১২ জন প্রতিবেদক। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাকি কেন্দ্রগুলোতে কোথাও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, কোথাও সামান্য বা বড় কারচুপি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
নির্বাচনে ঢাকা উত্তরে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ, দক্ষিণে ১৮ লাখ ৭০ হাজার এবং চট্টগ্রামে ১৮ লাখ ১৩ হাজার ভোটার ছিলেন। এর মধ্যে কত শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন, সে তথ্য নির্বাচন কমিশন আজ বুধবার জানাবে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনটি সিটি করপোরেশনেই এগিয়ে আছেন সরকার-সমর্থক মেয়র প্রার্থীরা। তাঁরা হলেন ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক, দক্ষিণে সাঈদ খোকন এবং চট্টগ্রামে আ জ ম নাছির উদ্দিন। তিন সিটি করপোরেশনে এগিয়ে থাকা কাউন্সিলর প্রার্থীদের বেশির ভাগই সরকারি দল-সমর্থক।
এ পরিস্থিতির মধ্যেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ দাবি করেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। ব্যাপক ভোটার উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মিডিয়া সেন্টারে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেন, কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শনকালে সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে কোনো সমস্যা হওয়া বা ভোটকেন্দ্রে যেতে ভয়ভীতি দেখানোর কথা তাঁকে বলেননি।
৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর গতকালের এই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে শঙ্কাই সত্য হয়েছে। অবশ্য আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। পরাজয়ের আশঙ্কায় বিএনপি ভোট বর্জন করেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, বিএনপি কিংবা তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা গতকালের পরিস্থিতি প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা, কোনো প্রতিবাদও করেননি। এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থক ও পুলিশের উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ডে তাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। এ কারণে বেশির ভাগ কেন্দ্রেই বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীদের এজেন্ট ছিলেন না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে দলটির তিন মেয়র প্রার্থী মাঝপথে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এর আগে আন্দোলনের মাঠ থেকে সম্পূর্ণ অগোছালো অবস্থায় নির্বাচনের মাঠে এসে দলটি অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে ফাঁকা মাঠে সরকার-সমর্থক ও দলের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীরা কারচুপির প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অনেকগুলো কেন্দ্রে নিজেদের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি করেন। ঢাকা দক্ষিণে কবি নজরুল কলেজ কেন্দ্রে এমনই এক সংঘর্ষের মধ্যে আটকে পড়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত। পরে বিজিবি গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর রাষ্ট্রদূত সেখান থেকে বের হন।
এ ছাড়া একাধিক কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ঢাকা উত্তরে কাফরুল উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মাহমুদা আক্তার ও বিদ্রোহী প্রার্থী মতি মোল্লার সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুরান ঢাকায় বাংলাদেশ ললিতকলা একাডেমি কেন্দ্রে ভোটারদের ওপর এক সাংসদের গানম্যানের গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনার তথ্য ও চিত্র সংগ্রহ করতে গণমাধ্যমকর্মীদের বাধা দিয়েছেন সরকারি দল-সমর্থক কিছু কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোনো কোনো কেন্দ্রে তাঁদের মারধর করা হয়েছে।
গতকাল চট্টগ্রামে কয়েকটি কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। ঢাকায় তিনটি কেন্দ্রে নির্বাচন বাতিল করা হয়। এগুলো হচ্ছে সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, শেরেবাংলা উচ্চবিদ্যালয়, কমলাপুর এবং আশরাফ মাস্টার আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়। চট্টগ্রামের একাধিক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ সাময়িক স্থগিত রেখে পরে চালু করা হয়।
ভোট গ্রহণের মাঝখানে নির্বাচন বর্জন করেন বিরোধী দল-সমর্থক মেয়র প্রার্থীরা। বেলা সোয়া ১১টায় চট্টগ্রামের বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। দলীয় নেতাদের উপস্থিতিতে এ সময় তিনি রাজনীতি থেকে অবসরের কথাও জানান দেন।
দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকায় বিএনপি-সমর্থিত দুই মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস ও তাবিথ আউয়ালের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।
জবরদস্তি ও কারচুপির পর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে এই নির্বাচন আক্ষরিক অর্থেই একতরফা হয়ে পড়ে। তার পরও সরকার-সমর্থকেরা বিভিন্ন এলাকায় কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ভরেন। এ পর্যায়ে কাউন্সিলর প্রার্থীরা বেশি তৎপর ছিলেন।
সরকারি দলের কৌশল: আগের রাতেই প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের আশপাশে সরকারি দল তাদের সমর্থিত প্রার্থীর পোস্টার ঝুলিয়ে ও বসার জায়গা সাজিয়ে দখল করে। রাতে অনেক কর্মী সেখানেই অবস্থান করেন। সকাল থেকে তাঁরা তৎপরতা শুরু করেন।
এ অবস্থায় বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রের আশপাশে যাওয়া কিংবা অবস্থান করার সুযোগই পাননি। এর পরও যাঁরা সেখানে যাওয়ার ও ভোটকেন্দ্রে অবস্থানের চেষ্টা করেছেন, তাঁরা হামলার শিকার হয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে যাঁদের বুথগুলোতে থাকার কথা ছিল, তাঁদের প্রায় সবাইকেই আগেভাগে এই দায়িত্ব পালন করতে না যাওয়ার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়।
এভাবে প্রথমে প্রায় সব ভোটকেন্দ্র প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক ও এজেন্টমুক্ত করা হয়। এরপর টার্গেট করা হয় গণমাধ্যমকর্মীদের। সকাল থেকেই বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনে তাঁদের বাধা দেওয়া হতে থাকে। পরে তা মারধর করে আহত করা থেকে জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া পর্যন্ত গড়ায়। এভাবে গণমাধ্যমকেও কোণঠাসা করে সরকারি দল-সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে অবাধে কারচুপি করা হয়।
অবশ্য এ অবস্থার মধ্যেও অনেক কেন্দ্রে ভোটাররা গিয়ে ভোট দিতে পেরেছেন। সকাল থেকে দুপুর প্রায় ১২টা পর্যন্ত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব কেন্দ্রেই ভোটাররা গিয়ে নির্বিঘ্নে ভোট দিয়েছেন। পরে অনেক কেন্দ্রেই ভোটারদের বের করে দিয়ে ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়।
ভোটারদের আক্ষেপ: ঢাকার অনেক কেন্দ্রে অসংখ্য ভোটার ভোট দিতে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। এ ধরনের সব ভোটারই ভোট দিতে না পেরে হতাশ হয়েছেন, আক্ষেপ করেছেন।
এমনই একজন ভোটার তাসলিমা বেগম। তাঁর স্বজনেরা প্রথম আলোকে বলেন, বয়োজ্যেষ্ঠ ও শারীরিকভাবে অসুস্থ এই নারী কয়েক দিন আগেও হাসপাতালে ছিলেন। ভোট দেওয়ার জন্যই তিনি তাড়াহুড়ো করে হাসপাতাল ছেড়েছেন। অথচ কাল বাসাবো বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে দেখেন, তাঁর ভোট দেওয়া হয়ে গেছে।
দক্ষিণের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী এস এম নাজিমউদ্দিনকে ভোট দেওয়ার জন্য সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী ফিরোজা বেগম ও ভাবি আসিয়া সুলতানা। গিয়ে দেখেন, তাঁদের ভোট অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছেন। এরপর তাঁরা বুথের বাইরে বের হয়ে চিৎকার করে এর প্রতিবাদ জানান। এর ফলে জাল ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনায় ওই কেন্দ্রে ভোট বাতিল করা হয়।
অন্য প্রার্থীদের ভোট বর্জন: উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের অন্য মেয়র প্রার্থীরাও দুপুরের আগে ও পরে ভোট বর্জন করেন। সকাল সোয়া ১০টায় পুরান ঢাকার আমলীগোলা এএমসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর নির্বাচন বর্জনের কথা বলেন জাতীয় পার্টি-সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদপ্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমেদ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সব কেন্দ্র সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। ব্যালট বাক্স আগে থেকেই ভরে রাখা হয়েছে।
ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী জোনায়েদ সাকি বেলা দুইটায় সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি পূর্ণ অনাস্থা ঘোষণা করেন।
একই সময়ে পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন-সমর্থিত দুই প্রার্থী ফজলে বারী মাসউদ ও আবদুর রহমান। এ ছাড়া চট্টগ্রামের তিন প্রার্থী বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মতিন, ইসলামী আন্দোলনের মো. ওয়ারেছ হোসেন ভূঁইয়া ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও এই নির্বাচনকে তামাশা আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিরোধী দলকে কৌশলে বয়কট করিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নেয় সরকার। আর এবার তা ছিনিয়ে নিল ভোট ডাকাতি করে। এতে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসন সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। নির্বাচনের নামে তামাশার মাধ্যমে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়েছে।’
জাতীয় রাজনীতিতে ঝড় তোলা এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের খেলায় গণতন্ত্র হেরেছে। সরকার-সমর্থকেরা বিরোধীদের বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রের কাছেই যেতে দেননি। অনেকটা ফাঁকা মাঠে পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় উন্মুক্ত কারচুপি করেছেন তাঁরা। আর বিরোধী দল বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীরা ভোট শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। চট্টগ্রামে মনজুর আলম বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার ঘণ্টা খানেক পরই ঢাকায় একই ঘোষণা দেন মির্জা আব্বাসের পক্ষে তাঁর স্ত্রী আফরোজা আব্বাস এবং তাবিথ আউয়াল।
প্রথম আলোর ২৭ জন প্রতিবেদক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১ হাজার ৯৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২৩টি ও ঢাকা দক্ষিণের ৮৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৫৬টি কেন্দ্র ঘুরে এই চিত্র পেয়েছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৭১৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২৭টি কেন্দ্র ঘুরেছেন প্রথম আলোর ১২ জন প্রতিবেদক। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাকি কেন্দ্রগুলোতে কোথাও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, কোথাও সামান্য বা বড় কারচুপি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
নির্বাচনে ঢাকা উত্তরে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ, দক্ষিণে ১৮ লাখ ৭০ হাজার এবং চট্টগ্রামে ১৮ লাখ ১৩ হাজার ভোটার ছিলেন। এর মধ্যে কত শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন, সে তথ্য নির্বাচন কমিশন আজ বুধবার জানাবে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনটি সিটি করপোরেশনেই এগিয়ে আছেন সরকার-সমর্থক মেয়র প্রার্থীরা। তাঁরা হলেন ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক, দক্ষিণে সাঈদ খোকন এবং চট্টগ্রামে আ জ ম নাছির উদ্দিন। তিন সিটি করপোরেশনে এগিয়ে থাকা কাউন্সিলর প্রার্থীদের বেশির ভাগই সরকারি দল-সমর্থক।
এ পরিস্থিতির মধ্যেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ দাবি করেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। ব্যাপক ভোটার উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মিডিয়া সেন্টারে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেন, কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শনকালে সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে কোনো সমস্যা হওয়া বা ভোটকেন্দ্রে যেতে ভয়ভীতি দেখানোর কথা তাঁকে বলেননি।
৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর গতকালের এই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে শঙ্কাই সত্য হয়েছে। অবশ্য আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। পরাজয়ের আশঙ্কায় বিএনপি ভোট বর্জন করেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, বিএনপি কিংবা তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা গতকালের পরিস্থিতি প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা, কোনো প্রতিবাদও করেননি। এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থক ও পুলিশের উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ডে তাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। এ কারণে বেশির ভাগ কেন্দ্রেই বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীদের এজেন্ট ছিলেন না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে দলটির তিন মেয়র প্রার্থী মাঝপথে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এর আগে আন্দোলনের মাঠ থেকে সম্পূর্ণ অগোছালো অবস্থায় নির্বাচনের মাঠে এসে দলটি অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে ফাঁকা মাঠে সরকার-সমর্থক ও দলের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীরা কারচুপির প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অনেকগুলো কেন্দ্রে নিজেদের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি করেন। ঢাকা দক্ষিণে কবি নজরুল কলেজ কেন্দ্রে এমনই এক সংঘর্ষের মধ্যে আটকে পড়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত। পরে বিজিবি গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর রাষ্ট্রদূত সেখান থেকে বের হন।
এ ছাড়া একাধিক কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ঢাকা উত্তরে কাফরুল উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মাহমুদা আক্তার ও বিদ্রোহী প্রার্থী মতি মোল্লার সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুরান ঢাকায় বাংলাদেশ ললিতকলা একাডেমি কেন্দ্রে ভোটারদের ওপর এক সাংসদের গানম্যানের গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনার তথ্য ও চিত্র সংগ্রহ করতে গণমাধ্যমকর্মীদের বাধা দিয়েছেন সরকারি দল-সমর্থক কিছু কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোনো কোনো কেন্দ্রে তাঁদের মারধর করা হয়েছে।
গতকাল চট্টগ্রামে কয়েকটি কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। ঢাকায় তিনটি কেন্দ্রে নির্বাচন বাতিল করা হয়। এগুলো হচ্ছে সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, শেরেবাংলা উচ্চবিদ্যালয়, কমলাপুর এবং আশরাফ মাস্টার আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়। চট্টগ্রামের একাধিক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ সাময়িক স্থগিত রেখে পরে চালু করা হয়।
ভোট গ্রহণের মাঝখানে নির্বাচন বর্জন করেন বিরোধী দল-সমর্থক মেয়র প্রার্থীরা। বেলা সোয়া ১১টায় চট্টগ্রামের বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। দলীয় নেতাদের উপস্থিতিতে এ সময় তিনি রাজনীতি থেকে অবসরের কথাও জানান দেন।
দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকায় বিএনপি-সমর্থিত দুই মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস ও তাবিথ আউয়ালের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।
জবরদস্তি ও কারচুপির পর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে এই নির্বাচন আক্ষরিক অর্থেই একতরফা হয়ে পড়ে। তার পরও সরকার-সমর্থকেরা বিভিন্ন এলাকায় কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ভরেন। এ পর্যায়ে কাউন্সিলর প্রার্থীরা বেশি তৎপর ছিলেন।
সরকারি দলের কৌশল: আগের রাতেই প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের আশপাশে সরকারি দল তাদের সমর্থিত প্রার্থীর পোস্টার ঝুলিয়ে ও বসার জায়গা সাজিয়ে দখল করে। রাতে অনেক কর্মী সেখানেই অবস্থান করেন। সকাল থেকে তাঁরা তৎপরতা শুরু করেন।
এ অবস্থায় বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রের আশপাশে যাওয়া কিংবা অবস্থান করার সুযোগই পাননি। এর পরও যাঁরা সেখানে যাওয়ার ও ভোটকেন্দ্রে অবস্থানের চেষ্টা করেছেন, তাঁরা হামলার শিকার হয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে যাঁদের বুথগুলোতে থাকার কথা ছিল, তাঁদের প্রায় সবাইকেই আগেভাগে এই দায়িত্ব পালন করতে না যাওয়ার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়।
এভাবে প্রথমে প্রায় সব ভোটকেন্দ্র প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক ও এজেন্টমুক্ত করা হয়। এরপর টার্গেট করা হয় গণমাধ্যমকর্মীদের। সকাল থেকেই বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনে তাঁদের বাধা দেওয়া হতে থাকে। পরে তা মারধর করে আহত করা থেকে জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া পর্যন্ত গড়ায়। এভাবে গণমাধ্যমকেও কোণঠাসা করে সরকারি দল-সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে অবাধে কারচুপি করা হয়।
অবশ্য এ অবস্থার মধ্যেও অনেক কেন্দ্রে ভোটাররা গিয়ে ভোট দিতে পেরেছেন। সকাল থেকে দুপুর প্রায় ১২টা পর্যন্ত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব কেন্দ্রেই ভোটাররা গিয়ে নির্বিঘ্নে ভোট দিয়েছেন। পরে অনেক কেন্দ্রেই ভোটারদের বের করে দিয়ে ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়।
ভোটারদের আক্ষেপ: ঢাকার অনেক কেন্দ্রে অসংখ্য ভোটার ভোট দিতে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। এ ধরনের সব ভোটারই ভোট দিতে না পেরে হতাশ হয়েছেন, আক্ষেপ করেছেন।
এমনই একজন ভোটার তাসলিমা বেগম। তাঁর স্বজনেরা প্রথম আলোকে বলেন, বয়োজ্যেষ্ঠ ও শারীরিকভাবে অসুস্থ এই নারী কয়েক দিন আগেও হাসপাতালে ছিলেন। ভোট দেওয়ার জন্যই তিনি তাড়াহুড়ো করে হাসপাতাল ছেড়েছেন। অথচ কাল বাসাবো বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে দেখেন, তাঁর ভোট দেওয়া হয়ে গেছে।
দক্ষিণের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী এস এম নাজিমউদ্দিনকে ভোট দেওয়ার জন্য সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী ফিরোজা বেগম ও ভাবি আসিয়া সুলতানা। গিয়ে দেখেন, তাঁদের ভোট অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছেন। এরপর তাঁরা বুথের বাইরে বের হয়ে চিৎকার করে এর প্রতিবাদ জানান। এর ফলে জাল ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনায় ওই কেন্দ্রে ভোট বাতিল করা হয়।
অন্য প্রার্থীদের ভোট বর্জন: উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের অন্য মেয়র প্রার্থীরাও দুপুরের আগে ও পরে ভোট বর্জন করেন। সকাল সোয়া ১০টায় পুরান ঢাকার আমলীগোলা এএমসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর নির্বাচন বর্জনের কথা বলেন জাতীয় পার্টি-সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদপ্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমেদ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সব কেন্দ্র সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। ব্যালট বাক্স আগে থেকেই ভরে রাখা হয়েছে।
ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী জোনায়েদ সাকি বেলা দুইটায় সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি পূর্ণ অনাস্থা ঘোষণা করেন।
একই সময়ে পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন-সমর্থিত দুই প্রার্থী ফজলে বারী মাসউদ ও আবদুর রহমান। এ ছাড়া চট্টগ্রামের তিন প্রার্থী বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মতিন, ইসলামী আন্দোলনের মো. ওয়ারেছ হোসেন ভূঁইয়া ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও এই নির্বাচনকে তামাশা আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিরোধী দলকে কৌশলে বয়কট করিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নেয় সরকার। আর এবার তা ছিনিয়ে নিল ভোট ডাকাতি করে। এতে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসন সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। নির্বাচনের নামে তামাশার মাধ্যমে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়েছে।’
%2B%E0%A6%93%2B%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%A8%2B%E0%A6%A6%E0%A6%B2-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BF%E0%A6%A4%2B%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A7%80%E0%A6%B0%2B%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A7%E0%A6%BF%2B(%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%87)%2Bl%2B%E0%A6%9B%E0%A6%AC%E0%A6%BF-%2B%E0%A6%86%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B8%2B%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE.jpg)
No comments