আইএসের উত্থান ও উপমহাদেশের রাজনীতি by এম সাখাওয়াত হোসেন

গণতন্ত্রহীনতা ও রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যেই এ ধরনের অপ​শক্তির উত্থান ঘটে
সপ্তাহ খানেকের বেশি সময় আগে (এ লেখার সময় থেকে) লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে আল-ঘানি তেলক্ষেত্র থেকে আইএস-সমর্থিত মিলিশিয়ারা আটজন লিবীয় গার্ডকে শিরশ্ছেদ করে নয়জন বিদেশিকে অপহরণ করেছে বলে প্রকাশ। অপহৃত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন বাংলাদেশি আর একজন করে ঘানা, চেক, অস্ট্রিয়ার নাগরিক এবং বাকি চারজন ফিলিপাইনের। অবশ্য কারা বা কোন মিলিশিয়া বাহিনী তাঁদের অপহরণ করেছে, তা নিশ্চিত না হলেও তেলক্ষেত্রে হামলা ও নৃশংসতার ধরন দেখে এবং লিবিয়ার দুই বিবদমান অবৈধ সরকারের, ত্রিপোলি সরকারের সামরিক মুখপাত্রের তথ্য অনুযায়ী, এ কাজ আইএসের (ইসলামিক স্টেট) বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অপহৃত এই দুই ব্যক্তির অবস্থান নির্ণয় করা যায়নি এবং কোনো গোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকভাবে দায় স্বীকার করেনি। উল্লেখ্য, লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি সরকারের উৎখাত এবং নৃশংস হত্যার পর থেকে অদ্যাবধি দেশটি গৃহযুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। বিশের অধিক অত্যন্ত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মিলিশিয়া বাহিনী সংঘাতরত।
লিবিয়া এখন কার্যত একধরনের ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। লিবিয়ার বৈধ সরকার বলে কথিত কাউন্সিল অব ডেপুটি বর্তমানে তবরুককে রাজধানী বানিয়ে সরকার চালাচ্ছে। লিবিয়ার এই সরকার এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত। এই সরকারের ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযানে তবরুক সরকারের অন্যতম সহযোগী জেনারেল খলিফা হাফতার যুদ্ধরত অবস্থায় রয়েছেন। অন্যদিকে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মিলিশিয়া, যার মধ্যে ইসলামপন্থীদেরই প্রাধান্য, একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। এদের কয়েকটি উপদল লিবিয়ার আইএস সংগঠনের সমর্থনে মিসরাতা বিমানবন্দর, মিরতে শহরসহ উত্তর মধ্য লিবিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল দখলে রেখেছে। ইতিমধ্যেই লিবিয়ার উত্তরাঞ্চলে প্রায় ১১টি তেলক্ষেত্র বন্ধ রয়েছে, যার মধ্যে আল-ঘানি ক্ষেত্রও রয়েছে। এখানে অস্ট্রিয়ার তেল কোম্পানি ভিওএএস পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। এখানেই কর্মরত ছিলেন অপহৃত দুই বাংলাদেশি।
লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি কোনোভাবে স্বাভাবিকের ধারেকাছেও নেই। গাদ্দাফির পতনের পর প্রথমে গোত্রভিত্তিক পরে অঞ্চলভিত্তিক সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। এককথায় ওই দেশে যে ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বিবদমান গোষ্ঠীর অবস্থান বিভিন্ন ধরনের ইসলামপন্থীর সঙ্গে সঙ্গে আইএসের দ্রুত উত্থান দেশটিকে চরমগোষ্ঠীর অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। এই অব্যবস্থার মধ্যে ২১ মিসরীয় খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীর আইএস কর্তৃক শিরশ্ছেদের ঘটনায় মিসর সরকারও লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থায় জড়িয়ে পড়েছে। ইসলামপন্থী এবং আইএস-সমর্থকদের দখল করা অঞ্চলে কয়েকবার বিমান হামলা চালানোর পর আইএস দমনে বহির্বিশ্বের, বিশেষ করে ন্যাটোর সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছে। মিসরের সঙ্গে ইউএই-ও লিবিয়ার তবরুক সরকারকে সহযোগিতা দিচ্ছে। বর্তমানে লিবিয়ার রাজধানী বেনগাজি কর্তৃপক্ষের যুদ্ধক্ষেত্র, তা নির্ণয় করা সহজ হচ্ছে না। লিবিয়ার দুই সরকারের মধ্যে সংঘাত, এর সঙ্গে রয়েছে কয়েক গ্রুপের বিভিন্নপন্থী মিলিশিয়ার অনবরত সংঘাত। এর মধ্যেই ক্রমাগতভাবে আইএসের দল ভারী হচ্ছে। বর্তমানে আইএসের অন্যতম শক্তিশালী নেতা আবু নাবিল-আল আনবারিকে উত্তর আফ্রিকার সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
লিবিয়ায় আইএসের শক্ত ঘাঁটি তবরুকের পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরীয় শহর দেরনা ও বেনগাজির পশ্চিমে আরেকটি বন্দর শহর সিরতাতে। মিসরাতা শহর আইএসসহ অন্যান্য জিহাদি সংগঠনের দখলে। আইএস ক্রমেই লিবিয়ার উত্তরাঞ্চলে প্রভাব বাড়াচ্ছে। অনেক মিলিশিয়া যার মধ্যে দেরনার ইসলামিক ইয়ুদ সুরা কাউন্সিল আইএসের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এককথায় ক্রমেই আইএস যোদ্ধারা উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ছে। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম, ফিলিপাইনের একসময়ের আল-কায়েদার সমর্থিত আবু সাইয়াফ গ্রুপ এখন আইএসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, যদিও এখনো আইএসের আনুগত্য ঘোষণা করেছে কি না জানা যায়নি।
হঠাৎ আইএসের ব্যাপক ব্যাপ্তি পশ্চিমা বিশ্বকে বিপাকে ফেলেছে। ক্রমেই আইএস বিভিন্ন দেশে সংঘাতে লিপ্ত ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের আকৃষ্ট করছে। ইতিমধ্যেই হাজার হাজার ইউরোপীয়, উত্তর আমেরিকা বিভিন্ন মুসলিম দেশের তরুণেরা সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধরত আইএস যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। শুধু তরুণেরাই নন, ইদানীং বেশ কিছু তরুণীকেও আইএস যুদ্ধক্ষেত্রে আকৃষ্ট করছে। এর মধ্যে ব্রিটেনের কয়েকজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণীর আইএসে যোগদান নিয়ে ওই দেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এমন একটি সংগঠন আইএস, যেখানে নারীদের সম–অবস্থান নেই, যেখানে নারী নেতৃত্বের প্রশ্নই অবান্তর, সেখানে তরুণীদের যোগদান করার কারণ খুঁজতে মাঠে নেমেছে একাধিক গবেষণা সংস্থা।
চারিত্রিক দিক থেকে আইএস আল-কায়েদা থেকে ভিন্ন, যদিও তাত্ত্বিক বিচারে দুই সংগঠনই সালাফি ও ওয়াহাবি ইসলামি তত্ত্বে বিশ্বাসী, তথাপি আল-কায়েদার চেয়ে আইএস আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করছে। আল-কায়েদা থেকে আইএসে যোগদান করায় সিরিয়া ও ইরাকে আল-কায়েদার অস্তিত্বই সংকটে। আইএসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ তাদের দখল করা অঞ্চলসহ অন্য মুসলিম দেশগুলোকে ঘোষিত ইসলামি খেলাফতে যোগদানের আহ্বান। তবে শুধু আহ্বানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি আইএস, রণক্ষেত্রের সাফল্য, ভূমি দখল এবং ওই অঞ্চলে ইসলামিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করে তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ইরাক-সিরিয়া আর লিবিয়ার বহু তেলক্ষেত্র আইএসের দখলে থাকায় অর্থের অভাব হয়নি ওই সংগঠনটির। অত্যাধুনিক অস্ত্রের অভাব নেই। কালোবাজারে তেলের ব্যবসায় উপার্জিত অর্থ দ্বারা এবং জিম্মিদের নিরাপত্তা প্রদানের বিনিময়ের অর্থে আইএস তাদের অভিযান চালাচ্ছে। বর্তমানে আইএসের প্রধান লক্ষ্য ইরাকে কথিত সুন্নি অঞ্চলে এবং বাশারের পতন ঘটিয়ে সিরিয়া অঞ্চল নিয়ে খেলাফতের ব্যাপ্তি ঘটানো।
লক্ষণীয় হলো, আইএসের এমন ব্যাপ্তি এবং দেশে দেশে ধর্মীয় চরমপন্থী গোষ্ঠীর তাদের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের ঘটনা। যদিও উপমহাদেশে এখনো আইএসের সহযোগী সংগঠনের নাম শোনা যায়নি। তবে এই অঞ্চলে, বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে তালেবান ও আল-কায়েদাসহ একাধিক জিহাদি বলে কথিত গোষ্ঠী রয়েছে। এরা প্রায় সবাই সশস্ত্র ও সংঘাতে লিপ্ত। তবে গবেষণালব্ধ তথ্য মোতাবেক আফগানিস্তানের তালেবানদের আইএসের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বা আনুগত্য প্রকাশের সম্ভাবনা কম। কারণ, মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের তালেবানরা ওই দেশে ইসলামিক খেলাফত বহু আগেই কায়েম করেছিল এবং আবার কায়েম করার ইচ্ছায় সংগ্রামের মধ্যে রয়েছে। একই অবস্থানে এখনো রয়েছে পাকিস্তানি তালেবান। তবে ইদানীং লাহোরে খ্রিষ্টান গির্জায় হামলা, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা অনেকটা আইএসের কৌশলের মতোই মনে হয়।
যা হোক, উপমহাদেশে অনেক উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী যথেষ্ট সক্রিয়। এগুলোর অনেকের ভাবাদর্শ আইএস সাদৃশ্য। বাংলাদেশে ইদানীং বেশ কয়েকটি ধর্মীয় উগ্রপন্থী সংগঠনের উত্থান লক্ষণীয়। তবে এদের সাংগঠনিক তৎপরতা এখনো আইএসের সঙ্গে জড়িত হওয়ার মতো হয়নি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যদি একটি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের ভাবাদর্শও ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার ওপরেই ভিত্তি করে রচিত, তবে তাদের কৌশল এখনো প্রচারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আইএস তথা অন্যান্য জিহাদি বলে আখ্যায়িত গোষ্ঠী বাংলাদেশের নারী নেতৃত্ববিরোধী। এমনটাই হিযবুত তাহ্রীরের প্রচারপত্রে প্রকাশ।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংঘাত ও সংকট বিদ্যমান, তার কারণে ক্রমেই যে ধরনের পরিস্থিতি, বিরাজনীতির প্রক্রিয়া, গণতন্ত্রহীনতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাতে উগ্রবাদীদের অনুপ্রবেশ ও পুনরুত্থান যে ঘটছে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। হালের ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ হত্যার ঘটনা তারই প্রমাণ দেয়।
আমাদের দেশের রাজনীতি এখন যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে বাদানুবাদের মাত্রা অতীতের সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। সরকারদলীয় অথবা সমর্থিত গোষ্ঠী যেভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আইএস ও অন্য জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার কথা টেনে আনছে, তা হিতে বিপরীত হতে পারে। এসব কট্টরপন্থী ধর্মীয় উগ্র সংস্থার ভাবাদর্শে নারী নেতৃত্বের স্থান নেই। আমাদের দেশের শীর্ষে রয়েছেন নারী নেতৃত্ব আর যত দিন দেশের নারীদের রাজনীতিসহ অন্যান্য জায়গায় ক্ষমতায়ন হবে, দেশে সুস্থধারার রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পথ সুগম থাকবে, তত দিন বাংলাদেশের সমাজে এ ধরনের উগ্র মতবাদের গোষ্ঠী সামাজিকভাবে সমর্থিত হবে না।
যেসব দেশে আইএস তথা সমমনা সংগঠনের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে বা ঘটছে, সেসব দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শূন্যতা ও গণতন্ত্রের অভাব পরিলক্ষিত। এ কথা ঠিক যে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ উগ্রপন্থীদের ব্যাপক উত্থানের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এর হুমকি থেকে পরিত্রাণ দোষারোপের, সংঘাতের অথবা ঘৃণার রাজনীতি নয়, প্রয়োজন দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশ। অন্যথায় বাংলাদেশও উগ্র ও চরমপন্থীদের বিচরণভূমি হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমাজের বিভাজন নয়, প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্য। এর দায়িত্ব একান্তভাবেই রাজনীতিবিদদের।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.