বল এখন সরকারের কোর্টে by আলফাজ আনাম

দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের চাবিকাঠি এখন পুরোপুরিভাবে ক্ষমতাসীনদের হাতে। সবার অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন নিয়ে স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত যে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ১৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে এই সঙ্কট নিরসনের একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বর্তমান সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে দিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ খুলবে। এই সংশোধনীর পর বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেই সঙ্কটের অবসান ঘটবে।
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালে বিএনপি কিভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন, তার উদাহরণও মনে করে দিয়েছেন। বিএনপি সরকারের প্রথম দফায় ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানায় তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি। সেই আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের দাবি মেনে নিয়ে বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে বাধ্য হয়েছিল। এর আগে ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই সংসদের একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সন্নিবেশিত করে সংবিধান সংশোধন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি বর্জন করেছিল। এই নির্বাচনকে উল্লেখ করা হয়েছিল ভোটারবিহীন নির্বাচন হিসেবে। কিন্তু সংবিধানের অতীব গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীটি এই সংসদেই পাস হয়েছিল।
বর্তমানে যে সংসদ রয়েছে ভোটারদের অংশগ্রহণের দিক দিয়ে তার গ্রহণযোগ্যতা আরো কম। এই সংসদের ১৫৪ জন সদস্য, অর্থাৎ বেশির ভাগই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, যাদের মধ্যে সংসদের স্পিকারও রয়েছেন। তার পরও এই সংসদের মাধ্যমে যদি সঙ্কটের নিরসন হয়, তাহলে ইতিহাসে হয়তো এই সংসদ অন্যভাবে মূল্যায়িত হতে পারে।
আজকে ক্ষমতাসীনেরা বারবার বলছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিবধানের বাইরে তারা একচুলও নড়বেন না।’ ফলে সংবিধানের মধ্যে থেকে সঙ্কট সমাধানের দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায়। বিএনপিও সে সময় যেকোনোভাবেই হোক সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরে থেকেই সমঝোতার চেষ্টা চালিয়েছিল। পর্দার অন্তরালে নানা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের ১২ ডিসেম্বর বিএনপি নেতারা বিরোধী দলগুলোর সাথে একটি সমঝোতায় আসার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে সরকার তিন দফা প্রস্তাব পেশ করে। সেই প্রস্তাব ছিল :
১. প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন দলের মধ্য থেকে একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করবে এবং সেই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। ২. নয়া প্রধানমন্ত্রী পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেবেন না। ৩. বিরোধী পক্ষ বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি প্রস্তাব বা রূপরেখা প্রণয়ন করবে।
তৎকালীন বিরোধী দল এ ধরনের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের সিদ্ধান্ত না নিলে তার সাথে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে না এবং আলোচনার একমাত্র বিষয়বস্তু হবে, নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। তারা আরো দাবি করেন, সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমে সেই আলোচনা সরাসরি প্রচার করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সে সময় আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির নেতারা ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
শুধু বিএনপির প্রস্তাব নয়, সে সময় রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে কমনওয়েলথ মহাসচিব ঢাকা এসেছিলেন। স্যার নিনিয়ান স্টিফেন সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বলেন। এই সরকারে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের পাঁচজন ও বিরোধী দলের পাঁচজন মন্ত্রী থাকবেন। তারা সবাই পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচিত এমপিদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন। এ ছাড়া বাকি একজন নির্দলীয় নিরপে ব্যক্তি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। যার ওপর স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর ভার ন্যস্ত থাকবে।
নিনিয়ানের এই প্রস্তাবে মতাসীন বিএনপি সম্মতি জানালেও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানিয়ে দেন, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্য কোনো ফর্মুলা তিনি মানবেন না। শুধু তা-ই নয়, এই প্রস্তাব দেয়ায় আওয়ামী লীগ স্যার নিনিয়ানের বিরুদ্ধে পপাতদুষ্টতার অভিযোগ আনে এবং তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করে কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমকো আনিয়াওকুর কাছে ফ্যাক্সবার্তা পাঠায়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শাহ এ এম এস কিবরিয়া এই ফ্যাক্সবার্তা পাঠিয়েছিলেন। তবে এমকো আনিয়াওকু আওয়ামী লীগের এ অভিযোগ নাকচ করে দেন। পাকিস্তান সফররত কমনওয়েলথ মহাসচিব ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নিনিয়ান কোনো পপাতিত্ব করেননি’। যা হোক, এর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সমঝোতার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। নিনিয়ান দেশে ফিরে যান। সহিংস কর্মসূচি চলতে থাকে।
আজকে বিরোধী দলের যে হরতাল অবরোধ কর্মসূচির সমালোচনা করা হচ্ছে, সে সময় এসব কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের জীবন অসহনীয় করে তোলা হয়েছিলো। কিন্তু সভা-সমাবেশ বা হরতালে পুলিশের গুলিতে কেউ নিহত হয়নি। গুম হননি কোনো রাজনৈতিক নেতা। ’৯৬ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আয়োজিত এক জনসভায় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভেবেছেন রোজার মাসে হরতাল হবে না। ইচ্ছামতো ভোট চুরি করে একদলীয় নির্বাচন করিয়ে নেবেন। কিন্তু তিনি জানেন না রোজার মাসেও যুদ্ধ হয়েছিল।’ লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা হরতাল চলাকালে ১৯৯৫ সালের ১৮ অক্টোবর ফার্মগেটের এক সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ সরকার হরতাল ছাড়া আন্দোলনের কোনো ভাষা বোঝে না। হরতালে মানুষের দুুঃখ-কষ্ট হয়। কিন্তু এ ছাড়া আমাদের করারই বা কী আছে?’ এ দিকে লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা হরতাল চলাকালে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমদ এক সমাবেশে বলেন, ‘৯৬ ঘণ্টা হরতাল রাজনীতির ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ’৯৪, ’৯৫ ও ’৯৬ সালের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মোট ৯৬ দিন হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ কর্মসূচি পালন করেছিল। এর মধ্যে ৭০ দিন হরতাল অবরোধ এবং ২৬ দিন অসহযোগ। এসব কর্মসূচিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পাশাপাশি একটি লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা, দুইটি ৭২ ঘণ্টা এবং পাঁচটি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকা হয়। আর ২৬ দিনের অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যে লাগাতার এ কর্মসূচি পালিত হয় ২২ দিন।
আমরা দেখছি, সে সময় ক্ষমতাসীনেরা সাংবিধানিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে সঙ্কট নিরসনের একাধিক প্রস্তাব দিলেও বিরোধী দল তা মানেনি। আর এখন বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা বিরোধী দলের সাথে আলোচনায় বসতে পর্যন্ত অস্বীকার করছেন। এখন ক্ষমতাসীনেরা যদি পুরনো দিনের কথা মনে করেন, তাহলে হয়তো রাজনৈতিক সঙ্কটের দ্রুত সমাধান হবে। হরতাল-অবরোধের যৌক্তিকতা তারা সে সময় ব্যাখ্যা করেছেন। ’৯৬-এর আন্দোলন যদি ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলন হয়, এখনকার আন্দোলন এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং তার যৌক্তিকতা আরো বেশি।
পার্থক্য হচ্ছে, তৎকালীন সরকার বিরোধী দলের আন্দোলনের কারণে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সে দাবি মেনে নিয়েছিল। আর বর্তমান সরকার আলোচনার পথে না গিয়ে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছে। কিন্তু এর পরিণতি ভেবে দেখা হচ্ছে না।
এখন বিরোধী দলের শিথিল হরতাল অবরোধের পর ক্ষমতাসীনেরা মনে হচ্ছে আরো কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন। এর মধ্যে গুম-খুনের পরিধি বাড়ছে। অনেকে আত্মতৃপ্তিতেও আছেন যে, বিরোধী দলের আন্দোলন থেমে যাচ্ছে। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন, জ্বালাও-পোড়াও আর দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এক বিষয় নয়। ভাঙচুর বা জ্বালাও-পোড়াওয়ের জন্য বেশি লোকের প্রয়োজন হয় না। আর রাজনৈতিক সঙ্কট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে দমন করা যায় না। সাময়িকভাবে স্তিমিত হলে আবার নতুন মাত্রায় তা জ্বলে উঠবে। কারণ, লাখ লাখ মানুষের অধিকার যদি হরণ করা হয় তার ক্ষোভ নানা মাত্রায় প্রকাশ পাবেই।
বিপুলসংখ্যক মানুষকে কারারুদ্ধ, গুম কিংবা ঘর-বাড়িছাড়া করে কখনো দেশে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব হবে না। এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে শুধু দেশের অর্থনীতি নয়, শেষবিচারে ক্ষমতাসীনদের চড়ামূল্য দিতে হতে পারে। রাজনৈতিক নেতাদের সব সময় ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়। ভাবতে হয় দল ও দেশের পরিণতির কথা। বর্তমান সরকার মনে হয়, সে কথা ভুলতে বসেছে। বিরোধী দলবিহীন একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশে কখনো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। অতীতেও এ ধরনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, বর্তমানেও ব্যর্থ হবে।
alfazanambd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.