ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়

নবগঠিত ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে বিএনপিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষুব্ধ ছাত্রদলের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের বড় একটি অংশ। তৃণমূল ছাত্রদলেও চলছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। ঘোষিত ১৫৩ সদস্যের কমিটিতে অন্তত ৬০ জন বিবাহিত। এদের প্রায় সবাই বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। চারজন ছাত্রনেতা রয়েছেন, যারা হত্যামামলার আসামি। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির মামলায় সাজা খেটে কেউ কেউ কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন। নিয়মিত ছাত্র নন ১৫৩ জনের কেউই। সভাপতি, সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম-সম্পাদকদের বয়সসীমা ৩৫ ঊর্ধ্ব। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগ থেকে এসেছেন কয়েকজন। স্থায়ীভাবে প্রবাসে থেকেই কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছেন দুজন। বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে কমিটির ৬০ ভাগই নিজেদের পছন্দসহ নেতা বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পদবঞ্চিতদের। এ কারণেই নির্ধারিত বয়সসীমায় আগের কমিটিতে থাকার পরও অন্তত ৩০ জন নেতার কমিটিতে জায়গা হয়নি।

এদিকে গতকাল বিকালেও নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন পদবঞ্চিতরা। এর আগে দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় তারা বৈঠক করেন। অবিলম্বে কমিটি পুনর্গঠনের দাবি জানান বিক্ষুব্ধরা। নতুন কমিটি বাতিলের দাবিতে আজ বেলা ১১টায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। আগের কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক পদবঞ্চিত ছাত্রনেতা তরিকুল ইসলাম টিটু গত রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সহস াধিক নেতা-কর্মী নিয়ে তারা আগামীকাল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করবেন। এ নিয়ে তাদের দুই দফা বৈঠক হয়েছে। বর্তমান কমিটির প্রায় অর্ধেক নেতা আগামীকালের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেবেন বলেও জানান তিনি। জানা গেছে, পদবঞ্চিতদের সঙ্গে বৈঠকে নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারসহ অন্তত ২০ জন সিনিয়র নেতা অংশ নিয়েছেন। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদলের ২০১ সদস্যবিশিষ্ট নতুন কমিটি গঠনের তথ্য জানানো হয়। সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব আহসানকে সভাপতি এবং যুগ্ম-সম্পাদক আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে সহসভাপতি ৩৩ জন, যুগ্ম-সম্পাদক ৩৫ জন, সহসাধারণ সম্পাদক ২৭ জন, সহসাংগঠনিক সম্পাদক পদে ২৮ জনকে মনোনীত করা হয়। ২০১ সদস্যের আংশিক কমিটির কথা বলা হলেও ১৫৩ জনের নাম পাওয়া যায় বিজ্ঞপ্তিতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন কমিটির সহসভাপতি মামুন বিল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সনি হত্যামামলার আসামি, জগন্নাথে ডাবল পুলিশ মার্ডার আসামি তারেকুজ্জামান তারেক এবং আবু আতিক আল হাসান মিন্টু জহুরুল হক হলের ছাত্রদল নেতা খোকন হত্যামামলার আসামি। এ ছাড়া প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল ইসলাম হিমেল বাংলাদেশ মেডিকেলের এক ছাত্র হত্যার অন্যতম আসামি।  এদিকে ছাত্রদলের নতুন কমিটির বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে কমিটি-বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এ কমিটির শীর্ষ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে দলীয় তহবিলের ৪০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। এ নিয়ে ওই সময়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে চারদফা বৈঠকেও এসব অভিযোগ তোলা হয়। নতুন সভাপতি রাজিব আহসান সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষে লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্র। রাজিবের গ্রামের বাড়ি ভোলায়। অবিবাহিত এ ছাত্রনেতার বয়স অন্তত ৩৭ বছর। এক-এগারোর সময়ে তার বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বিগত ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসির কর্মসূচিতে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া রাজিব পরিবারের অধিকাংশ সদস্য আওয়ামী লীগ করেন বলেও সংগঠনের একাধিক নেতা জানান। তবে নিজের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ সাংবাদিকদের কাছে অস্বীকার করেন রাজিব আহসান। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের কথাও জানান তিনি।সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম-সম্পাদক ও বিদায়ী কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৬-৯৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র আকরাম বিদায়ী সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলের অনুসারী। তাদের দুজনের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। অন্তত ৩৫ বছর বয়স্ক আকরাম এখনো অবিবাহিত। টুকু-আলিম কমিটির সময় বিদ্রোহ করার কারণে বহিষ্কৃত হন। আকরামের বিরুদ্ধে গত মেয়াদে কমিটি নিয়ে অর্থ-বাণিজ্য করার অভিযোগও রয়েছে। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে আকরামুল হাসান বলেছেন, এটা ভিত্তিহীন। তাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করতেই কেউ কেউ এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় অনেক দিন তিনি কোনো পদ পাননি। টুকু-আলিম কমিটির সময়ে তাকে ঢাবি শাখার যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয়েছিল। টুকুর অনুসারী আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষে দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী। নতুন সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার ছাত্রত্ব শেষ করেছেন বহু আগে। বয়সে বর্তমান কমিটিতে সবার সিনিয়র ইসহাক সরকার বিবাহিত। তার বয়স অন্তত ৪০ বছর। তিনি দুই সন্তানের জনকও।
বিবাহিতরা যারা : নতুন কমিটিতে বিবাহিত ছাত্রনেতার সংখ্যা অন্তত ৬০ জন। এর মধ্যে রয়েছেন- সহসভাপতি আজমল হোসেন পাইলট, তারেকুজ্জামান তারেক, আলমগীর হোসেন সোহান, আবুল মনসুর খান দীপক, নাজমুল হাসান, মনিরুল ইসলাম মনির,  ফয়সাল আহমেদ স্বজল, মাসুদ খান পারভেজ, মামুন বিল্লাহ, সাদিউল কবির নীরব, আবদুল ওয়াহাব, নিয়াজ মাখদুম মাসুম বিল্লাহ, আবদুল হান্নান মিয়া, জাকির হোসেন খান, জাকির  হোসেন মিন্টু, জয়দেব জয়, ইয়াসিন ফেরদৌস মুরাদ, আনোয়ারুল করিম মিলন, নিহার হোসেন ফারুক ও মনিরা আক্তার রিক্তা। যুগ্ম-সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, মিয়া মোহাম্মদ রাসেল, আবুল হাসান, বায়েজিদ আরেফিন, শাহ নাসির উদ্দিন রুম্মন, মির্জা আসলাম আলী, গাজী রেজোয়ানুল হক রিয়াজ, সেলিনা সুলতানা নিশিতা, শওকত আরা উর্মি, শাহিনুর নার্গিস, বি এম নাজিম মাহমুদ, শফিকুল ইসলাম শফিক, এহতেশামুল হক, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ইসমাইল হোসেন খান শাহীন, আরিফা সুলতানা রুমা, আবুল কালাম আজাদ টিটু, এস এম জাহাঙ্গীর আলম এবং মনজুর মোর্শেদ পলাশও বিবাহিত। এ ছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সুমন দেওয়ান, গোলাম আজম সৈকত, হাবিবুর রহমান হাবিব, ইলতুতমিশ সওদাগর, শাহীনুর বেগম সাগর, আল আমিন সিদ্দিকী আকাশ ও আফরোজা খানম নাসরিন। এ ছাড়া যুগ্ম-সম্পাদক পদমর্যাদায় সদস্য খন্দকার এনামুল হক ও হুমায়ুন কবীর রওশনও বিবাহিত। এর বাইরেও কয়েকজন গোপনে বিয়ে করেছেন বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিবাহিতদের প্রায় সবাই বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। এদের অনেকেই একাধিক সন্তানের পিতামাতা।ব্যবসায়ী যারা : ছাত্রদলের নেতাদের বড় একটি অংশই শেয়ারবাজার ব্যবসায়ী। এর মধ্যে আজমল হোসেন পাইলট, মনিরুল ইসলাম মনির, মামুন বিল্লাহ, আবুল হাসান, মামুন হোসেন ভুইয়া সরাসরি শেয়ার ব্যবসায় জড়িত। ঠিকাদারি ব্যবসা করেন- তারেক উজ্জামান তারেক, আবুল মনসুর খান দীপক, নিয়াজ মাখদুম মাসুম বিল্লাহ, সাফায়াত হোসেন রিপন, জাকির হোসেন মিন্টু, আনোয়ারুল করীম মিলন, আসাদুজ্জামান আসাদ, জসিম উদ্দিন প্রমুখ।সরাসরি আইন পেশায় যুক্ত নিহার হোসেন ফারুক ও ইলতুতমিশ সওদাগর। ইয়াসিন হোসেন মুরাদ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। আল আমিন সিদ্দিকী আকাশের হোটেল ব্যবসা রয়েছে। এহতেশামুল হক কম্পিউটার ব্যবসায়ী। এ ছাড়া বিভিন্ন ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা হলেন- হুমায়ুন কবীর, ইশতিয়াক নাসির, আবদুল হান্নান মিয়া, খলিলুর রহমান খলিল, জহিরুল ইসলাম বিপ্লব, জয়দেব জয়, মিয়া মো. রাসেল, মিজানুর রহমান সোহাগ, আবদুল করীম সরকার, শাহ নাসির উদ্দিন রুম্মন, মির্জা আসলাম আলী, শওকত আরা উর্মি, হাবিবুর রহমান ডালিম, এহতেশামুল হক, মাহবুবুর রহমান পলাশ, আনোয়ার হোসেন, মোজাহিদুল ইসলাম, আরিফ মো. রহমান, ইসমাইল হোসেন খান শাহীন, আরিফা সুলতানা রুমা, সাগর মজুমদার, আবুল কালাম আজাদ টিটু, এস এম জাহাঙ্গীর আলম, মনজুর মোর্শেদ পলাশ, ইসহাক সরকার, সুমন দেওয়ান, মিজানুর রহমান সুমন, গোলাম আজম সৈকত, হুমায়ুন কবীর রওশন প্রমুখ।
যুগ্ম-সম্পাদক মিজানুর রহমান সোহাগও চাকরিজীবী। এ ছাড়া শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গেও একাধিক ছাত্রনেতা যুক্ত বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগ থেকে ছাত্রদলের কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছেন আবু আতিক আল হাসান মিন্টু, আসাদুজ্জামান আসাদ, নুরুল হুদা বাবু ও শাহ নাসির উদ্দিন রুম্মন। এ ছাড়া সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম রিবলু ও ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক ফাহমিদা মজিদ ঊষা স্থায়ীভাবে লন্ডনে বসবাস করছেন।
এদিকে নতুন কমিটি ঘোষণার পর এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছেন পদবঞ্চিতরা। বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার ছাড়াও নেতৃত্বে রয়েছেন- আগের কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক ওবায়দুল হক নাসির, মশিউর রহমান মিশু, ফেরদৌস আহম্মেদ মুন্না, তরিকুল ইসলাম টিটু, মনিরুল ইসলাম সোহাগ, এম কামরুজ্জামান, নুরুজ্জামান মুকিত লিংকন, মশিউর রহমান মিশু, আ স ম আবদুল মান্নান ফরহাদ, শামসুজ্জোহা সুমন, নাজমুল হাসান অভি, রাশেদুল আহসান রাশেদ, মাহবুবুল আলম আজম, জাবেদ হাসান স্বাধীন, শাহ আলম চৌধুরী, সাঈদ উদ্দিন আহমেদ সুমন, রফিকুল ইসলাম রফিক, হাসানুজ্জামান, আদনান আলম বাবু, আশরাফুজ্জামান রনি, মোশাররফ হোসেন মশু, হাসান আলী মামুন নাহিদ, ফুয়াদ আহমেদ, মোখলেসুর রহমান, নজিবুল ইসলাম, আবু ফয়সাল জিহাদ, মোমিনুল ইসলাম মোমিন প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.