অক্লান্ত ও বেপরোয়া ছাত্রলীগ! by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

ঢাকাগামী ট্রেনের ৩৮০টি টিকিট চেয়েছিলেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। নিয়ম মেনে আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু যথাসময়ে টিকিট না পেয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছেন চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে গুরুতর আহতও হয়েছেন ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী। একজন কর্মী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

ছাত্রলীগের দাবি, রেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের বাড়াবাড়ির কারণেই এ রকম ঘটনার সূত্রপাত। রেল কর্তৃপক্ষ অবশ্য আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য রেখেছিল। কোন পক্ষের বক্তব্য যথার্থ, সে কথা সাধারণ মানুষ বুঝে ওঠার আগেই স্টেশনমাস্টার ও বুকিং ক্লার্ককে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিন নিরাপত্তারক্ষীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে, তা না জানলে যে ধরনের পরিণতি হওয়ার কথা, তা-ই হয়েছে এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তাঁদের ভোগান্তি এখানেই শেষ হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ, এর মধ্যেই চট্টগ্রাম রেলের স্টেশনমাস্টার ও জিআরপি থানার ওসিসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ছাত্রলীগ।
রেলওয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিস্মিত হয়ে বললেন, সরকারের লাখ লাখ টাকার সম্পদ নষ্ট করল কে আর মামলা হলো কাদের বিরুদ্ধে? স্টেশনে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই অনেক কিছু পরিষ্কার হবে।
ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল বা পুলিশ শুরুতেই ছাত্রলীগ কর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছিল কি না, সে ঘটনা জানার জন্য সিসি ক্যামেরার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ভাঙচুর কে বা কারা করেছিল, তা জানার জন্য নিশ্চয় এ ধরনের ক্যামেরার ফুটেজ দরকার পড়ে না। পুলিশ বাড়াবাড়ি করে থাকলে তার তদন্ত ও বিচার হোক। কিন্তু লাখ লাখ টাকার সরকারি সম্পদ নষ্ট করার বিষয়টি নিয়ে কি তদন্ত আদৌ হবে?
যা-ই হোক, ঢাকার সমাবেশে শেষ পর্যন্ত যোগ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীরা। সেই সমাবেশ তাঁদের কতটা উদ্দীপ্ত করতে পেরেছিল জানি না। সাবেক ও বর্তমান নেতাদের বক্তব্য থেকে কতটা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ অনুভব করেছেন, তা-ও জানি না। কিন্তু ফিরে আসার পথে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কর্মীরা ট্রেনে বসার আসন নিয়ে যেভাবে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেললেন, মারামারি করে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন চার সতীর্থকে, তাতে তো এ কথা মনে হতেই পারে, সারা দেশের কর্মীদের জড়ো করে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের আয়োজন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এই সমাবেশ তাঁদের না দিয়েছে রাজনৈতিক সচেতনতা, না দিয়েছে ঐক্যের বার্তা।
লোহাগাড়া বারআউলিয়া কলেজের ছাত্রলীগ নেতা তৌকিরুল ইসলাম (১৯) সেদিনই (১ সেপ্টেম্বর) মারা গেছেন। আহতরা নানা শারীরিক সমস্যা নিয়ে হয়তো বেঁচে আছেন, কিন্তু এই মানসিক আঘাত তাঁরা আর কখনো কাটিয়ে উঠতে পারবেন কি না জানি না।
দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটি তাৎক্ষণিক বাতিল করা হয়েছে। আবার নতুন করে কমিটি গঠনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রেলস্টেশনে গোলযোগের ঘটনায় যত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল স্টেশনমাস্টার বা পুলিশের বিরুদ্ধে, সে রকম কোনো ব্যবস্থা উচ্ছৃঙ্খল দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এমনকি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আদালতে রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পুলিশের ওসিসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার ব্যাপারে যে রকম উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, এখানে সেই উৎসাহও অনুপস্থিত। কার বিরুদ্ধে মামলা করবেন তাঁরা? আক্রমণকারী ও আক্রান্ত উভয়েই তো ছাত্রলীগ।
এদিকে, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠনের তৎপরতা শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির একটি দল এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চট্টগ্রামে এসেছেন। ১০ দিনের মধ্যে কমিটি ঘোষণা করা হবে এমন ঘোষণাও দিয়েছেন তাঁরা। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাত উপজেলা ও ছয় পৌরসভা থেকে শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য আগ্রহী ১১৫ জন ছাত্র তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে বেশ একটা উৎসবের ভাব সবার মধ্যে। এই উৎসবের আনন্দে চাপা পড়ে গেছে তৌকির নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীর মৃত্যুর শোক। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও যত আগ্রহী নতুন কমিটি গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে, তৌকিরের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান বা দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তির সম্মুখীন করার ব্যাপারে তত আগ্রহী বলে মনে হয় না। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে তার রেশ শেষ হয়ে যায় না। তা-ই আবার নতুন অঘটনের ইন্ধন জোগায়। মনে পড়ে, মাত্র বছর দেড়েক আগে ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ৬৪তম মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে আন্দরকিল্লা দলীয় কার্যালয়ের সামনে খুন হয়েছিলেন দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আবদুল মালেক চৌধুরী (জনি)। সেই ঘটনার বিচার হয়নি।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান পত্রিকান্তরে বলেছেন, ছাত্রলীগের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীদের কারণে খুন, মারামারি এবং সাংগঠনিক দুরবস্থা বিরাজ করছে। অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে কোনো আদর্শিক চেতনা নেই। তারা ছাত্রলীগের কর্মী নয়।

প্রশ্নে ওঠে, তাহলে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করবে কে?
ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের মতো বড় ছাত্রসংগঠনগুলোতে ইদানীং আকারে বড় কমিটি গঠনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হয়েছে ২৯১ জনের। তাতে শুধু সহসভাপতি ও সহসম্পাদকের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৫ ও ২৫ জন। বলা হচ্ছে, এক একটি ওয়ার্ড কমিটি গঠিত হয়েছিল ১৮ বছর আগে, থানা কমিটি ২০ বছরের পুরোনো। সে ক্ষেত্রে নেতা-কর্মীদের মূল্যায়নের জন্য কমিটির আকার বড় করার বিকল্প নেই। কিন্তু বিশাল বহরের এই কমিটির কোন পদের কে কোথায় গিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন, তার হিসাব রাখবে কে? ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের পদপ্রাপ্তদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা তো নতুন কিছু নয়।
প্রতিদিনই সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে ছাত্রলীগ। বলা বাহুল্য, এসব সংবাদ বেশির ভাগই নেতিবাচক, হতাশাজনক। সংবাদকর্মীরা ছাত্রলীগের নানা মাত্রার ‘তৎপরতার’ সংবাদ প্রকাশ করে করে ক্লান্ত। কিন্তু ছাত্রলীগ তো অক্লান্ত। তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে কে?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.