মানুষের শরীর তো যন্ত্র নয় by কাজল ঘোষ

মধ্যরাতের একটি ফোন আমাকে এখনও খুব ভাবায়। ফোনটি ছিল আমার বোনের বাসা থেকে আসা। রাতে আমার ভাগনির ফোনে চিৎকারে বুঝতে পারি বড় রকমের দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। আমার ভগ্নিপতি ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে ভাল চিকিৎসার খোঁজে নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করলে অনেকেই পরামর্শ দিলেন বাংলাদেশে সবচেয়ে ভাল চিকিৎসক কে কে বড়ুয়া। উনার হাত সোনার হাত। উনি ব্রেইনের সার্জারি খুবই ভাল করেন। নিশ্চিন্ত ভরসায় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার ফাইল নিয়ে উনার সরকারি চাকরিস্থল বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে দেখা মেলে। তীব্র মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে আমি আর আমার বোন যখন একটু কথা বলার সুযোগ চাইলাম। চিকিৎসক তখন ফাইলটি ছুঁয়েও দেখার প্রয়োজন অনুভব করেননি। তিনি ব্যবস্থা নিয়ে না দেখার মতোই বললেন, এখানে আমার কিছুই করার নেই। আমরা বললাম, আমরা আপনাকে দিয়েই চিকিৎসা করাতে চাই। সরকারি না হলেও আপনি বেসরকারি যেখানে চিকিৎসা করাবেন সেখানেই আমরা যেতে চাই। আমাদের অনুনয় বিনয়ে খানিকটা থেমে বললেন, আপনারা কোথায় চিকিৎসা করাবেন এটা আপনাদের সিদ্ধান্ত। আপনারা আমার এখানে চিকিৎসা করাতে চাইলে আমি যেখানে আছি আসুন দেখা যাবে। এই বলে আমরা তখন ঢাকা মেডিকেলে ছুটি। সেখানের বারান্দায় শুয়ে আছন ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত ভগ্নিপতি। ঢাকা মেডিকেলে দু’দিন থাকা অবস্থায় নিউরোসার্জারি বিভাগে নিলে সবাই পরামর্শ দিলেন উনার সার্জারি লাগবে। এখানে ভাল ব্যবস্থা নেই। অনেকের পরামর্শে কে কে বড়ুয়ার তত্ত্বাবধানে ঢাকা মেট্রোপলিটনে চিকিৎসা দেয়া হলো। টানা দুই মাস লড়াই করে তিনি পরলোক গমন করেন। আমরা আমাদের পরিবারের পক্ষে সবশেষটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু বড় দুঃখ হচ্ছে এই লম্বা সময়ে ডাক্তারবাবুকে কখনই দেখিনি রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে সেটা ভাল কি মন্দ যা-ই হোক। অনেকবার আমি নিজেও চেষ্টা করেছি উনার সঙ্গে কথা বলার। প্রাণ খুলে কখনওই তিনি কথা বলেননি। আমরা দিন যত যাচ্ছে রোগীর অবস্থা খারাপ হচ্ছে টের পাচ্ছিলাম। আরও উন্নত চিকিৎসা কি হতে পারে এ নিয়ে আমার বোন কাটিয়েছেন মাসের পার মাস। টাকা যোগাড়ের বিষয় তো ছিলই। কিন্তু নির্বিকার ছিলেন চিকিৎসক। কখনও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার তাগিদ অনুভব করেননি। শুনেছি অনেক দীর্ঘ লিস্ট ডক্তারবাবুর। সরকারি হাসপাতাল, বাইরে চেম্বার, ক্লিনিকে অপারেশন। প্রতিদিন কত রোগী, কত স্বজন। এগুলো নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? কাগজেপত্রে আর সমস্যা হলে নার্সদের দেখেছি ফোনে কথা বলে পরামর্শ নিতে। তবু তিনিই বাংলাদেশের নিউরোসার্জনদের একজন। উনার প্রতি শুভকামনা থাকলো। আমার পরিবারের একজনের বাঁচার লড়াইয়ে উনি পাশে ছিলেন।

একদিন খুব সকালে ফোন। বাবার বুকে ব্যথা অনুভব করছেন। নিকটতম উপজেলা সরকারি হাসপাতালই ভরসা। সেখানে সকাল থেকে অপেক্ষায় থেকে থেকে যখন দুপুর গড়িয়েছে তখনও ডাক্তার সাহেবের দেখা নেই। বাধ্য হয়ে বাবাকে পরামর্শ দিলাম। ঢাকায় তো টাকা দিলে ডাক্তার মেলে। এখানে তো আরও বিপদ। পরে নিকটস্থ বাজারে গিয়ে এক এমবিবিএস ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে ওষুধ নিয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন। ভাবুন তো, সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনই নাকি এখানে ডাক্তারদের এমন না পাওয়ার খবর আছে। তাহলে ওই এলাকার লোকদের বিভিন্ন স্থানে ডাক্তার খুঁজে বেড়ানো ছাড়া কি-ই বা করার আছে। সরকার আরও অনেক বেশি করে ডাক্তার নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাও হাজারে হাজারে। কি হবে কে জানে। আমাদের এখানে যেভাবে ভুয়া ডাক্তারদের দাপট চলছে। তাতেতো কারোরই আর মরার জন্য আগামীতে ডাক্তার খুঁজতে হবে না। মোহাম্মদপুরে কিছুদিন আগেই র‌্যাবকে দেখলাম ড্রিল মেশিনে হাড় ফুটো করে চিকিৎসা দেয়ার পদ্ধতির জনকদের ধরতে। একই ভাবে ভুয়া লাইসেন্সে হাসপাতাল, ক্লিনিক আর চেম্বারের তো অভাব নেই। ক’দিন আগেই আমার সিনিয়র এক কলিগ হঠাৎ করেই দুর্ভাবনায় পড়ে গেলেন। কারণ, তার শরীরে ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের ডাক্তাররা বাইয়োপসি করতে বলেছেন। কারণ, তার নাকি ক্যানসারের সংক্রামক দেখা দিয়েছে। এই খবর জানার পর থেকে ওই  পরিবারের সকল সদস্যেরই অবস্থা কি হতে পারে এটা সহজেই অনুমান করা যায়। খুব দ্রুতই ওনারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। তারা বাইরে গিয়ে পরীক্ষা করালে দেখতে পেলেন; না এরকম কোন জীবাণুর সংক্রমণ ঘটেনি। আর বাইয়োপসি করারও দরকার নেই। নিজ দেশের বাইরে সবাই চিকিৎসার জন্য দৌড়াবে এটা কামনা করি না। কিন্তু এই যদি অবস্থা হয় তাহলে বিকল্প কি? পশ্চিমবঙ্গের একেকটি হাসপাতালে জরিপ করলে দেখা যাবে সেখানের ৮০ শতাংশ রোগীই বাংলাদেশের। তারা বেশির ভাগই আমাদের এখানের বিভ্রান্তিকর সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়েছেন সেখানে। আর থাইল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুরের কথা আপনি গুগলে সার্চ দিলেই দেখতে পাবেন।

দেরি হয়ে গেল বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। অনেক আগেই এই লেখাটি লিখবার প্রয়োজন অনুভব করছিলাম। দু’দিন আগে মিটফোর্ড হাসপাতালে আবারও নার্স আর ইন্টার্নি চিকিৎসকদের মধ্যে সঙ্কটে রোগীদের অবস্থা ত্রাহি। বহু দূর-দূরান্তের রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসে ফিরে গেছেন। অবস্থা এমন পাটা-পুতায় ঘষাঘষি, মরিচের দশা শেষ। কিন্তু এই পরিস্থিতি শুধু মিটফোর্ডে নার্স আর ইন্টার্নি চিকিৎসকরাই করেছেন তা নয়। সম্প্রতি এরকম বেশকিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকরা ঢালাওভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। মিটফোর্ডে এর আগে রিপোর্ট করতে গেলে ইন্টার্নি ডাক্তাররা একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিকদের প্রহার করে এবং ক্যামেরা ভাঙচুর করে। রাজশাহী মেডিকেলের ঘটনাতো আরও ভয়াবহ। সেখানে নারী ইন্টার্নি চিকিৎসকরা যেভাবে লোহার রড ও লাঠিসোটা নিয়ে সাংবাদিকদের মেরেছে তা অবর্ণনীয়। সেখানে এক ডজন সাংবাদিক মারাত্মক আহত হয়েছেন। এরপর ঢাকা মেডিকেল ও বারডেমেও একই ঘটনা ঘটেছে। পুরনো ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেলেও একইরকমের ঘটনা ঘটেছে। রোগীদের দুর্ভোগ নিয়ে ও রোগী  মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করতে গেলে সাংবাদিকদের ওপর বেপরোয়া হয়ে মারধরের ঘটনা ঘটায় ইন্টার্নি ডাক্তারা। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নানা  আশ্বাস দিয়েছেন। দু’একজনের শাস্তিও হয়েছে। কিন্তু তাতে কি চিকিৎসা যে সেবামূলক পেশা তা নিয়ে ভাবার সুযোগ কি এই ইন্টার্নি ডাক্তারদের আছে। আর থাকবেই  বা কি করে, কারণ তারাইতো হাসপাতালগুলোর মূল কর্তার ভূমিকায়। বড় ডাক্তাররা ইন্টার্নি করতে আসা এই তরুণ-তুর্কীদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে নিজস্ব চেম্বার আর ক্লিনিক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইন্টার্নিরা নার্সদের দিয়ে অধিকন্তু দায়িত্ব পালন করেন নতুবা গল্পে মশগুল হন। রোগীদের ব্যথায় কাতর হওয়া আর স্বজনদের ব্যথা বোঝার সময় তাদের কোথায়?

লেখাটির শিরোনামের ব্যাখ্যায় আসি। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘অলীক সুখ’ উপন্যাস অবলম্বনে এটির সেলুলয়েড আকারে তৈরি করেছেন নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের একজন ডাক্তারের ক্লিনিকে একজন সদ্যপ্রসূত নবজাতকের মায়ের মৃত্যুর ঘটনাকে উপজীব্য করে ছবিটিতে উঠে এসেছে সেখানের ডাক্তারদের ক্লিনিকে রোগীদের সময় না দেয়া, অধিক চেম্বার আর ক্লিনিক করে কিভাবে রোগীদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ছবিটির মূল চরিত্র কিংশুক। যিনি একজন রোগীকে প্রসব সময়ের আগেই বাড়তি অর্থ উপার্জনের জন্য সিজার করালে কবিতা মণ্ডলের মৃত্যু হলে তার পরিবার ওই ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। এক সময় তা-ও টাকা দিয়ে ডাক্তারবাবু ম্যানেজ করেন। কিন্তু যে রোগী মারা গেছেন সে তার অশরীরী আত্মা হয়ে ওই পরিবারে ঢুকে পড়ে। এবং এক সময় ডাক্তারবাবুর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হলে নিজের অজান্তেই পায়ে স্লিপ কেটে পুকুরে পড়ে গেলে মৃত্যু হয়। ক্লিনিকে একজন রোগীর মৃত্যু কিভাবে একজন ডাক্তারের পুরো পরিবারকে গ্রাস করে তা ফুটিয়ে তোলা হয়। ছবির মূল জায়গাটি ছিল আদালতের নির্দেশে তদন্ত টিমের প্রধান ড. অম্বরীশ রায়ের সঙ্গে ড. কিংশুকের কথোপকথন। এটির উল্লেখ করেই লেখাটির ইতি টানবো। জেরার এক পর্যায়ে ড. অম্বরীশ কিংশুককে বলছে, ঠিক বা ভুল ডাক্তারদের হয়। ডাক্তররা তো মনুষ্য সমাজের বাইরে নয়। সেদিন পোস্ট অপারেটিভ পরীক্ষা নিরীক্ষা তুমি নিখুঁতভাবে করেছিলে। ছাত্র জীবনে ভাল ছাত্র ছিলে। কিন্তু টাইম-সময় তোমার নেই। তুমি দৌড়াচ্ছো। দিনে পাঁচটা চেম্বার। গড়ে দশটা রোগী হলে প্রতিদিন ৫০টা রোগী আর পাঁচটা অপারেশন। তাহলে দিনে ৩/৪ মিনিট করে একেকজন রোগীকে সময় দিচ্ছো। কি করছো কিংশুক? কার পেছনে দৌড়াচ্ছো। চার মিনিটে রোগীর মন জানবে না রোগ জানবে। কি করে তোমার ওপর রোগীর বিশ্বাস তৈরি হবে। আমরা এখনও বিশ্বাস করি অর্ধেক রোগ মনে মনে। তা কথা বলে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে দূর করা যায়। মানুষের মনতো যন্ত্র নয়- তার একটা ভাষা আছে। কান পেতে শুনলে সেই ভাষা শোনা যায়। এখানেই লেখাটির ইতি টানতে চাই। আমাদের এখানের ডাক্তাররা যদি রোগীদের মন বুঝতেন তাহলে হয়তো আমাদের রোগ যন্ত্রণা অনেকাংশেই দূর হয়ে যেত। আর আমরা তাদের ওপর ক্রমাগত অনাস্থা আর অবিশ্বাস নিয়ে বাইরে ছুটতাম না।

পুনশ্চ: ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি কারও ওপর ক্ষোভ থেকে নয়- এক অগাধ বিশ্বাস আর প্রত্যাশা থেকে।

No comments

Powered by Blogger.