মৃদুল জীবিত ফিরেছেন, কিন্তু... by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

মৃদুল চৌধুরীকে ভাগ্যবানই বলতে হবে, তিনি জীবিত ফিরে আসতে পেরেছিলেন। চট্টগ্রামের এই স্বর্ণ ব্যবসায়ী নগরের কোতোয়ালির বাসা থেকে দোকানে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়েছিলেন গত ১১ ফেব্রুয়ারি। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে কুমিল্লার বুড়িচং কংসবাজার এলাকায় অপহরণকারীরা তাঁকে ফেলে যায়। পরে পুলিশ ও পরিবারের লোকজন তাঁকে চট্টগ্রামে ফিরিয়ে আনেন। তাঁকে ভাগ্যবান বলছি, কারণ নারায়ণগঞ্জে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারসহ সাতজন অপহৃতের মতো পরিণতি বরণ করতে হয়নি তাঁকে। অপহরণের কয়েক দিন পর এই সাতজনের লাশ ভেসে উঠেছিল নদীতে। কিন্তু মৃদুল জীবিত ফিরতে পেরেছিলেন। এটাও কম পাওয়া তো নয়!
চট্টগ্রামের মৃদুলের অপহরণ ঘটনা প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের নজরুল ইসলাম ও চন্দন সরকারের কথা ওঠার কারণ উভয় ক্ষেত্রেই অপহরণকারী হিসেবে অভিযোগের আঙুল উঠেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) দিকে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় নজরুলের স্ত্রী অভিযোগ করেছিলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনেরই আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন র‌্যাবকে দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা অবশেষে এ ঘটনার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্তির কথা স্বীকার করেছেন। ভারতে আটক নূর হোসেনকেও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
এদিকে মৃদুল চৌধুরী অপহরণ ঘটনার তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এ রহস্যের কোনো সুরাহা হয়নি। পুলিশের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দায়সারা, তারা যেন ঘটনাটিকে এখানেই ধামাচাপা দেওয়ার পক্ষে।তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মৃদুল চৌধুরী অপহরণের ঘটনার তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’ তবে তিনি স্বীকার করেছেন, মৃদুল যে অপহৃত হয়েছিলেন, সেটা নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই।
মৃদুলের অপহরণের ঘটনাটি যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তাঁকে কারা অপহরণ করেছিল, এই প্রশ্নের মীমাংসা করা নিশ্চয় পুলিশেরই দায়িত্ব। অপহরণকারীদের শনাক্ত করতে পেরেছেন কি না, এই প্রশ্নের জবাবে মৃদুল চৌধুরী নিজে বলেছেন, ‘ছয় দিন আমার চোখ ও হাত বাঁধা ছিল। আমি অপহরণকারীদের চিনতে পারি নাই। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপহরণকারীদের চিহ্নিত করা হোক।’ এর চেয়ে নিরাপদ উত্তর আর কী হতে পারে? ।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে র‌্যাব-২-এর কর্মকর্তা মেজর রকিবুল আমিনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৮০ ভরি স্বর্ণ লুটের মামলা করেছিলেন মৃদুল চৌধুরী। সিআইডি এ মামলার তদন্ত করছে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অপহৃত হন তিনি। যতই তিনি এখন বলুন অপহরণকারীদের শনাক্ত করতে পারেননি, মুক্ত হওয়ার পর বিচারিক জবানবন্দিতে কিন্তু স্বীকার করেছিলেন, র‌্যাবের বিরুদ্ধে ৮০ ভরি স্বর্ণ লুটের মামলা করায় অপহরণকারীরা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তদন্ত প্রক্রিয়া তো এ পথেই এগোতে পারত। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রধান বলছেন, ‘মেজর রকিবুল আমিনের বক্তব্য আমরা নিয়েছি। এ ছাড়া র‌্যাব-২-এর পরিচালকের সঙ্গেও কথা বলেছি। তদন্তে তাঁদের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কী প্রক্রিয়ায় কথা বললে স্বীকারোক্তি আদায় করা যায়, তা ভালো জানে পুলিশ। কিন্তু সাধারণের জন্য প্রযোজ্য সেই প্রক্রিয়া এই ‘বিশেষ’ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যদি নেওয়া না হয়, তাহলে এই তদন্ত অর্থহীন।
প্রসঙ্গক্রমে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার তালসরা দরবার শরিফের ঘটনাটি স্মরণ করা যেতে পারে। ২০১১ সালের ৪ নভেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে র‌্যাব-৭-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল জুলফিকার আলী মজুমদারের নেতৃত্বে কালো ও সাদাপোশাক পরা ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল তল্লাশির জন্য ঢুকেছিল তালসরা দরবার শরিফে। পীর আহম্মদ ছফা শাহ্কে দোতলার একটি কক্ষে এবং তাঁর স্ত্রী ও মেয়েদের নিচতলার একটি কক্ষে আটকে রেখে তল্লাশি চালান র‌্যাবের সশস্ত্র সদস্যরা। একপর‌্যায়ে আহম্মদ ছফার কাছ থেকে জোর করে চাবি নিয়ে স্টিলের আলমারি খুলে ছয়টি ট্রাভেল ব্যাগে রাখা দুই কোটি সাত হাজার টাকা নিয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ গাড়িতে তোলেন তাঁরা। মসজিদ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য এ টাকা গচ্ছিত ছিল। অথচ শত শত গ্রামবাসীর সামনেই এ টাকা নিয়ে চলে যান র‌্যাবের সদস্যরা।
২০১২ সালের মার্চে ডাকাতির মামলা দায়ের করেছিলেন দরবার শরিফের গাড়ির চালক ইদ্রিস আলী। এর আগেই অবশ্য লুটের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল র‌্যাব। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে প্রচলিত আইনে মামলা করার সুপারিশ করা হয়। তালসরা দরবার থেকে লুট করা টাকায় মাত্র ২০ দিনের মধ্যে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট এবং ফরিদপুরে গ্রামের বাড়িতে আবাদি জমি কিনেছিলেন লে. কর্নেল জুলফিকার আলী মজুমদার। এই তথ্য মিলেছে খোদ র‌্যাবের তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে। তদন্তে তৎকালীন অধিনায়কসহ র‌্যাবের চারজন সদস্য ও দুই সোর্সের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পায় কমিটি।
এ ঘটনায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা আন্তরিক হলে বা সতর্ক থাকলে বিচার-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হতো। দরবার শরিফের দুই কোটি সাত হাজার টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি। একইভাবে অপহৃত মৃদুল চৌধুরী জান ফিরে পেলেও মাল পাননি। অর্থাৎ, তাঁর ৪০ ভরি স্বর্ণ-রহস্যেরও কিনারা হয়নি এখনো।
সম্প্রতি র‌্যাব ভেঙে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি দিয়েছে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ (এইচআরডব্লিউ)। এই সংগঠনের চিঠিতে র‌্যাবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ তুলে বলা হয়, ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরবর্তী সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার এবং আওয়ামী লীগ সরকারও এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে র‌্যাবকে দায়মুক্তি দিয়ে এসেছে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান দুজনই র‌্যাব বিলুপ্ত করে দেওয়ার এই দাবিকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করেছেন।
র‌্যাবের প্রয়োজন আছে কী নেই, সেই বিতর্কে যাব না। তবে র‌্যাবের সদস্যদের দ্বারা কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তার যথাযথ বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে তো কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। বিচার ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে ভুক্তভোগীদের আশ্বস্ত করা সরকারের অবশ্যকর্তব্য।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.