যুদ্ধবিরতির নামে প্রহসন -ইসরাইলের নৃশংস হামলা অব্যাহত

প্রহসনের এক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে গাজায় হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। যুদ্ধবিমান এফ-১৬ থেকে সমুদ্রপাড়ের একটি শরণার্থী শিবির ধ্বংস করে দেয়ার মাধ্যমে ওই যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ৬ মিনিটের মধ্যেই তা ভেঙে পড়ে। এ হামলায় ৮ বছর বয়সী একটি কন্যা শিশু নিহত হয়। গতকাল সকালে ইসরাইল একতরফাভাবে ৭ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। ইসরাইল এ সপ্তাহান্তে স্থল অভিযান বন্ধ রেখেছে। কিন্তু বিমান, জলপথে হামলা তীব্র করে। এরই মধ্যে তারা গাজায় জাতিসংঘের কমপক্ষে ৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে হামলা করেছে। সেখানে নিহত হয়েছেন বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষ। গাজার এ যুদ্ধ চতুর্থ সপ্তাহ ধরে চলছে। এ সময়ে কমপক্ষে ১৮০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে ইসরাইলের নিহত হয়েছে ৬৭ জন। এর মধ্যে ৬৩ জনই সেনা সদস্য। গতকাল যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেয়ার পরই গাজায় উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী ও বার্তা সংস্থা এএফপি’র সাংবাদিকরা রিপোর্ট করেন যে, তারা শুনতে পান যুদ্ধবিমান এফ-১৬ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। তা একটি তিনতলা ভবনের ওপরে পড়ে। এতে তা ধসে পড়ে। রোববার জাতিসংঘ পরিচালিত একটি শরণার্থী শিবিরে নৃশংসভাবে হামলা চালিয়ে হত্যা করে কমপক্ষে ১০ জনকে। এ ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন। তিনি বলেন, ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। তারা লজ্জাজনক হামলা চালিয়েছে। এ অবস্থাকে তিনি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করেন। এ হামলাকে লজ্জাজনক বলে আখ্যায়িত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, যদি কোন বেসামরিক ব্যক্তির ওপর অনিচ্ছাকৃত হামলা হয়ে থাকে তার জন্য ইসরাইল দুঃখ প্রকাশ করছে। তিনি এ সময় জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে হামাস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উত্তম স্থান হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে তিনি যে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন এরই মধ্যে তার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি ওবামা প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বলেছেন, তারা যেন তাকে হামাসের বিষয়ে দ্বিতীয় কোন চিন্তা করতে বাধ্য না করেন। আন্তর্জাতিক মহল যখন ইসরাইলের এই নৃশংস হামলার নিন্দা জানাচ্ছে, ভিন্ন ধর্মের মানুষ গাজাবাসীর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে হোয়াইট হাউস, মালয়েশিয়া সহ বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে, তখনও একগুঁয়ে  নেতানিয়াহু গাজায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা অব্যাহত রেখেছে।  তিনি বেশ কয়েক বার যুদ্ধবিরতির নাটক সাজিয়ে তা লঙ্ঘন করেছেন।
গাজায় জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রে হামলা মারাত্মক অপরাধ- বান কি-মুন
জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে ইসরাইলের নৃশংস হামলা মারাত্মক অপরাধ। এটা নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ। এতে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ইসরাইলের এমন বর্বর হামলার নিন্দা জানিয়ে এসব কথা বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন। তিনি আরও বলেছেন, এমন কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের ভয়াবহ লঙ্ঘন। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেন পসাকি বলেছেন, এমন বোমা হামলা ভয়াবহ, ভীতিকর। রোববার ইসরাইল জাতিসংঘ পরিচালিত একটি স্কুলে এই হামলা চালায়। গাজায় এই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন হাজারের বেশি মানুষ। যখন মিশরে একটি যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ চলছিল তখন ইসরাইল জঘন্যতম ওই হামলা চালায়। ইসরাইলের নৃশংস হামলায় গাজায় ৫ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। চিকিৎসা সরঞ্জাম ফুরিয়ে গেছে। মর্গে আর লাশ রাখার জায়গা নেই। এ এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। এ বিষয়ে সতর্কতা উচ্চারণ করেছে জাতিসংঘ। ওদিকে গতকাল সাত ঘণ্টার মানবিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরাইল। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়োয়াভ মরদেচাই বলেছেন, গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে ৭ ঘণ্টার জন্য রাফা বাদে গাজার সর্বত্র যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকবে। তারা এ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে আগের দিন জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রে নির্মম বোমা হামলার পরের দিন। ওদিকে এ ঘোষণার মাত্র ৬ মিনিট পরে তারাই তা লঙ্ঘন করে। একদিকে চরমভাবে তারা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে, তেমনি যুদ্ধবিরতি দিয়ে দেখাতে চায় তাদের মধ্যেও আছে মানবিকতা। এটা শুধু বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য। গাজা পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের ক্রিস গানেস বলেছেন, গাজা ভেঙে পড়েছে। রোববারের হামলাকে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, এই মাতলামি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
শ’ শ’ লাশ!

গাজায় এখন ধ্বংসস্তূপের ভিতরে লাশ। হাসপাতালের মর্গে লাশ। সেখানেও আর জায়গা হচ্ছে না। লাশ রাখা হচ্ছে ফ্রিজে। একটা দু’টা নয়- শ’ শ’ লাশ। রাস্তায় পড়ে আছে লাশ। কোল্ড স্টোরেজে যে ভাবে আলুর বস্তা রাখা হয় তারচেয়েও এলোমেলো ফেলে রাখা হয়েছে লাশ। মাটি আর সইতে পারছে না এত লাশ। তার বুক আজ হু হু করে কাঁদছে। এত্ত লাশ দেখে কাঁদছে ভিনধর্মী সাধারণ মানুষের অন্তরাত্মা। শিশুর লাশ। সদ্যজাত শিশুর লাশ। সবেমাত্র ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর লাশ। এখন তার গা থেকে মুছে যায় নি গর্ভধারিণী মায়ের রক্তের ছাপ। এসব শিশুর লাশ বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদছেন পিতা-মাতা। অথবা তারা দু’জনেই হয়েছেন অতীত। বিধ্বস্ত কংক্রিটের মাঝ থেকে উঁকি দিয়ে আছে মৃত শিশুর মুখ। পড়ে আছে যুবকের লাশ। যুবতীর লাশ। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার লাশ। স্বামীর লাশ। স্ত্রীর লাশ। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। এতটুকু গাজায় লাশের সংখ্যা ২০০০ ছুঁই ছুঁই। দৃষ্টিসীমা যতদূর যায় ততদূর শুধু লাশ আর লাশ। ধ্বংসস্তূপ সরালেই লাশ। রেড ক্রিসেন্টের উদ্ধারকর্মীরা সে লাশ দেখে, রক্তপাত দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। আর যা-ই হোক তারা তো রক্তমাংসের মানুষ। তাদের অন্তরাত্মা কাঁছছে। এত লাশ দেখে, এত নির্মম মৃত্যু দেখে তারা দিশাহারা। ইসরাইল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মারাত্মকভাবে লঙ্ঘন করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুনের এই শুদ্ধ উচ্চারণেই কি এতগুলো মৃতের, তার স্বজনের ফরিয়াদ শেষ হয়ে যাবে! এর বিচার কে করবে! ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর হাত এখন ফিলিস্তিনের গাজাবাসীর রক্তে রঞ্জিত। তিনি যে পরিমাণ মানুষ হত্যা করছেন ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কি তার চেয়েও বেশি কুর্দিকে হত্যা করেছিলেন? যদি সে জন্য সাদ্দাম হোসেনের বিচার হয়, তার ফাঁসি হয়- তাহলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কি পুরস্কার পাওয়া উচিত? তার কি বিচার হবে! কে করবে বিচার! উল্টো তাকে ২২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের অস্ত্র পুরস্কার তুলে দেয়া হচ্ছে। আর যা-ই হোক তার তো আত্মরক্ষার অধিকার আছে! লিবিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি কত মানুষ হত্যা করেছিলেন? তার বিরুদ্ধে যত দ্রুত ন্যাটো পদক্ষেপ নিয়েছে ইসরাইলের বেলায় কেন তারা বেমালুম বেহুঁশ। তাদের হুঁশ ফেরাবে কে! কোথায় জাতিসংঘ! বিবৃতির মধ্যে কেন আজ তারা বন্দি! কোথায় নিরাপত্তা পরিষদ! এত্ত লাশেও কি কারও মন ভরছে না! আর কত! আর কত লাশ হলে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হবে! মানবতার সংজ্ঞা আজ কি নতুন করে লিখতে হবে গুণীজনদের! গাজায় চারদিকে শুধু বিধ্বস্ত ভবনের হাহাকার। দূরে দাঁড়িয়ে আছে শুধু একটি মিনার। ওখানে মসজিদ ছিল। তারই সাক্ষ্য বহন করছে সে। কতগুলো মসজিদ ধ্বংস করেছে ইসরাইল! একটি, দু’টি, তিনটি! না, কমপক্ষে ৬টি। এসব মসজিদে মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শুধু। আল্লাহর দরবারে তাদের ফরিয়াদ কি পৌঁছায় না! কোথায় হামলা করে নি ইসরাইল! হাসপাতাল, জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্র, মসজিদ, লোকালয়- কোথায় করে নি হামলা! রাস্তার কালো পিচে লেগে আছে তরতাজা রক্ত। বহমান নদীর মতো বয়ে চলেছে তা। আর কত রক্ত! আর কত লাশ! এত লাশ এতটুকু গাজা ঠাঁই দেবে কোথায়!

No comments

Powered by Blogger.