আগের চেয়ে শক্তিশালী হামাস!

গাজার রাফায় জাতিসংঘ পরিচালিত বিদ্যালয়ে ইসরায়েলি
হামলায় আহত এক শিশুকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে
ছুটছেন এক ফিলিস্তিনি। গতকাল ওই বিদ্যালয়ে
ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়। এএফপি
গাজায় বেপরোয়া ও নৃশংস অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। কিন্তু এই ২৮ দিনের বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের মধ্য দিয়ে কী অর্জন করেছে ইসরায়েল? এর আগে বিভিন্ন সময় গাজা বা লেবাননে চালানো অভিযানের মতোই এবারও প্রতিপক্ষের অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। তবে হতাহতের শিকার বেশির ভাগই বেসামরিক মানুষ। তার পরও গাজায় অভিযান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। কিন্তু ইসরায়েলি নেতারা যখন হিসাব মেলাতে বসছেন, তখন দেখছেন তাঁদের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এই যুদ্ধ থেকে রাজনৈতিক কোনো অর্জন এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিপরীতে লাভবান হয়েছে সেই ফিলিস্তিন তথা ইসলামভিত্তিক সংগঠন হামাস। মাস খানেক আগের তুলনায় হামাস এখন আরও অনেক শক্তিশালী। বৈশ্বিক নানা ইস্যুর কারণে ফিলিস্তিনের বিষয়টি গত কয়েক বছর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেমন আলোচিত হয়নি। নির্দিষ্ট করে বললে, ২০১১ সালের আরব বসন্তের পর থেকে ফিলিস্তিন কিছুটা আড়ালে চলে যায়। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর এই বিভৎস অভিযান আর তাতে দেড় হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি সেই অবস্থা বদলে দিল। আসলে বেশ কয়েক বছর ধরেই পশ্চিম তীর ও গাজার প্রায় ৪০ লাখ ফিলিস্তিনির দুর্দশার চিত্র বিশ্বের নজরের বাইরেই ছিল। গত মাসে সেই চিত্র আবার বিশ্বের সামনে ফুটে উঠেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী শিবির থেকে হাসপাতাল—কোথাও নিরাপদ নয় ফিলিস্তিনিরা। নিরাপদ নয় নারী, শিশু, বৃদ্ধ। ইসরায়েলি বোমা, ট্যাংকের গোলা পড়ছে সর্বত্র। ইসরায়েলের একজন মুখপাত্র এসব হামলার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, বোমা বা ট্যাংকের গোলা শরণার্থী শিবির বা হাসপাতালে পড়ছে, এর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। বরং ইসরায়েল লক্ষ্য করে হামাসের ছোড়া রকেট ইসরায়েলে না পৌঁছে এসব জায়গায় পড়তে পারে। ওই মুখপাত্রের এই যুক্তি অবশ্য ধোপে টেকে না।কারণ সংক্ষিপ্ত পরিসরের যুদ্ধ হলেই কেবল এটা সম্ভব হতে পারে। গত শুক্রবার অবশ্য ইসরায়েল নিজের ‘আসল মনোভাব’ প্রকাশ করে বলেছে, অভিযানে কত ফিলিস্তিনি নিহত হলো, তাতে ইসরায়েলের কিছু যায়-আসে না। ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনের সময় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটে।
খ্রিষ্টান মিলিশিয়াদের হাতে এক হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি হত্যার শিকার হন বলে বলা হয়।ওই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে ছিল ইসরায়েলি বাহিনীই। গাজার বর্তমান অভিযানেও সে ধরনের হত্যাযজ্ঞের চিত্র ফুটে উঠছে। এর আগে ২০১২ সালে গাজায় ‘অপারেশন পিলার অব ডিফেন্স’ নামে পরিচালিত আট দিনের ইসরায়েলি অভিযানে ১৬৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়। ২০০৮-২০০৯ সালে ‘অপারেশন কাস্ট লিড’ নামে ২২ দিনের ইসরায়েলি অভিযানে নিহত হয় এক হাজার তিন শয়ের বেশি ফিলিস্তিনি। এসব অভিযানের মতোই চলমান ইসরায়েলি অভিযানেও ফিলিস্তিনি হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবে সবকিছু আগের মতো নেই। তখন ইসরায়েলের প্রতিবেশী দেশগুলো অনেকটা স্থিতিশীল ছিল কিংবা তৎকালীন সরকারগুলোর কঠোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন সিরিয়া ও ইরাকে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি চলছে, মিসরে রাজনৈতিক পালাবদল ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, লিবিয়ায় একধরনের অরাজকতা চলছে আর লেবানন বা জর্ডানের স্থিতিশীলতাও আগের চেয়ে নড়বড়ে। এর সঙ্গে ওই অঞ্চলের আরেকটি সংকট যোগ হলো—সেটা হলো গাজায় ইসরায়েলি অভিযান। ইসরায়েল তার সামরিক শক্তির পুরোটা কাজে না লাগিয়েও হামাসের বিরুদ্ধে হয়তো সামরিক বিজয় অর্জন করতে পারবে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারবে কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ হামাস নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে তাদের জায়গা নেবে আইএসআইএস বা অন্য কোনো কট্টরপন্থী সংগঠন।
ইসরায়েল কেন বারবার রক্তাক্ত অভিযানে অংশ নেয়—এ প্রশ্নের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইসরায়েলি লেখক ও শান্তিকর্মী ইউরি আভনেরি। তাঁর মতে, ইসরায়েলি বাহিনীতে তরুণ সেনার সংখ্যা অনেক, যাদের তিন বছর বয়স থেকে ইহুদি হিসেবে আত্মোৎসর্গ করার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। এ কারণেই হয়তো এত ফিলিস্তিনির প্রাণহানি সত্ত্বেও ইসরায়েলিরা মনে করে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি তাদেরই প্রাপ্য। অথচ দেড় হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহতের বিপরীতে হামাসের রকেট হামলায় নিহত হয়েছে তিন বেসামরিক ইসরায়েলি ও ইসরায়েলে কর্মরত থাইল্যান্ডের একজন নাগরিক। ইসরায়েল হামাসের রকেট হামলা ঠেকাতে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। আর চলমান রকেট হামলায় এটা প্রমাণিতও হয়েছে, হামাসের রকেট হামলা কতটা অকার্যকর। তার পরও হামাসকে নিয়ে ইসরায়েলিদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ করে ইসরায়েল সরকার। ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটি বার্তা ছড়ানো হয়েছে, হাজার হাজার হামাস যোদ্ধা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পোশাক পরে সুড়ঙ্গপথে ইসরায়েলে প্রবেশের পরিকল্পনা করছে। এটা হয়তো গাজায় সুড়ঙ্গ ধ্বংসের নামে অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে সাধারণ ইসরায়েলিদের জোর সমর্থন পাওয়ার একটি প্রচারণা। ইসরায়েলের বড় দুর্বলতা হলো, তারা নিজেদের ছড়ানো মিথ্যা প্রচারণাগুলোকে বিশ্বাস করে।

No comments

Powered by Blogger.