একটি পশ্চাৎপদ নীতি by মাহফুজ আনাম

স্বাধীন গণমাধ্যম ও সরকারের মধ্যে যে কোন দ্বন্দ্বে প্রাথমিকভাবে সরকার জিতলেও শেষ পর্যন্ত স্বাধীন গণমাধ্যমেরই জয় হয়। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের কারণে জাতির গঠনমূলক মূল্যবান সময়ের বিপুল অপচয় হয়। সরকার প্রাথমিকভাবে জয় লাভ করে সরকারি প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী প্রভৃতির ব্যবহার, পেশীশক্তির প্রয়োগ ও অর্থের জোরে। প্রাথমিকভাবে এই বিজয় সম্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত বাক-স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যমের জয় হয় জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে। তবে এই প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। আমাদের সরকার মনে হয় ইতিহাসের এই ধারা থেকে কিছুই শিখছে না। কেন এই নতুন সম্প্রচার নীতিমালা? স্বাধীন বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্জন হলো স্বাধীন গণমাধ্যম। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর এ দেশে বড় আকারে স্বাধীন গণমাধ্যমের বিকাশ ও বিস্তৃতি ঘটে। বর্তমানে গণমাধ্যমে একটি স্বাধীন, দায়িত্বশীল ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিদ্যমান। বাংলাদেশের গণমাধ্যমখাতের সামগ্রিক পরিসরে সম্প্রচার মাধ্যমগুলো সাম্প্রতিক সময়ে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তা চমকপ্রদ। যদিও তাদের আরও বাধা-বিপত্তি পেরোতে হবে তারপরও এই অগ্রগতি এক কথায় বিস্ময়কর। টেলিভিশন খবর জানার প্রচলিত ধারাকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। বিভিন্ন ঘটনা সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে দর্শকদের কাছে এর জনপ্রিয়তা বিপুল বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একই সঙ্গে সরকারকেও আরও বেশি জবাবদিহিতার সম্মুখীন করেছে। আমি গর্বের সঙ্গে স্মরণ করতে চাই রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময় আমাদের টেলিভিশন সাংবাদিকরা দিন- রাত বিরতিহীনভাবে ঘটনাটি সরাসরি প্রচার করেছে এবং বিশ্বব্যাপী আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। টেলিভিশনে ঘটনার সরাসরি সম্প্রচারের ফলে খবর প্রচারে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে যা দর্শকদের কাছে গণমাধ্যমকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে। এফ.এম রেডিওর ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। অনলাইন এবং ডিজিটাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলোও কমবেশি সফল। এই প্রবন্ধে আমি এই মাধ্যমগুলোর আলোচনায় যাবো না। বর্তমানে প্রস্তাবিত সম্প্রচার নীতিমালা ছাড়াই এসব সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। টিভি স্টেশন এবং এফএম রেডিওগুলো বিদ্যমান আইন, নীতিমালা বিশেষ করে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে প্রদত্ত নীতিমালা মেনেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। যদি বিদ্যমান আইন ও নীতিমালা দিয়েই টেলিভিশন ও এফএম রেডিও মাধ্যমে যুগান্তকারী অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয় তবে কেন একটি নতুন নীতিমালার প্রয়োজন, বিশেষ করে এমন একটি নীতিমালা যা এই অগ্রগতির প্রতিবন্ধক হবে বলে মনে হয়। একটি নতুন নীতিমালা প্রণয়নের একটিই গ্রহণযোগ্য যুক্তি থাকতে পারে আর তা হল নীতিমালার মাধ্যমে সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর বিকাশ ত্বরান্বিত করা। কিন্তু প্রস্তাবিত নীতিমালায় তা ঘটবে না, কেননা, এই নীতিমালা গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে আগ্রহী, বিকশিত করতে নয়। সরকার বলছে নীতিমালার বিষয়টি সাংবাদিকদের প্রস্তাব থেকেই আনা হয়েছিল। এটা সত্য। কিন্তু সাংবাদিকদের দাবি ছিল একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন সেই নীতিমালা তৈরি করবে এবং নীতিমালা তৈরির সময় সকল অংশীজনদের বিশেষ করে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর মালিকদের মতামত গ্রহণ করবে। কিন্তু তারা কখনোই আমলাদের দ্বারা নীতিমালা তৈরির পক্ষপাতী ছিলেন না যেখানে অন্যান্য অংশীদারদের নামমাত্র অংশগ্রহণ থাকবে এবং তাদের অধিকাংশ মতামত গ্রহণই করা হবে না। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪ গেজেট অনুযায়ী, সম্প্রচার নীতিমালাটিতে ৭টি অধ্যায় আছে। প্রথম অধ্যায়ের ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অংশে যে সব মৌলিক মূল্যবোধের কথা বলা হয়েছে আমরা তার সাথে একমত। ১.২.১ থেকে ১.২.৫ ধারা পর্যন্ত যেসব কথা বলা হয়েছে আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই। তারপরও মূল্যবোধবিষয়ক এসব ধারা অপ্রয়োজনীয় ভাবে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে যার কোন কোনটি বাদ দিয়ে অথবা অন্যধারার সাথে যুক্ত করে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অংশটিকে আরও সংক্ষিপ্ত ও সুপাঠ্য করে তোলা যেত। দ্বিতীয় অধ্যায়টি সম্প্রচার লাইসেন্স প্রদান নিয়ে এবং এখানে বলা হয়েছে সম্প্রচার কমিশন গঠনের পর সম্প্রচার লাইসেন্স প্রদানবিষয়ক বিস্তারিত নীতিমালা তৈরি করা হবে। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে সম্প্রচারের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই তিন অধ্যায়ে প্রায় ৭০টি ধারা ও উপধারা আছে। প্রত্যেকটি ধারা-উপধারা গণমাধ্যমে সম্প্রচারের বিষয়বস্তু (Content) কেন্দ্রিক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক। সম্প্রচার নীতিমালায় সম্প্রচারের বিষয়বস্তুর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলো নিয়েও কথা বলেছে যা নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এবং এইসব সূক্ষ্ম বিষয়ে নীতিমালা আরোপ করে সহজেই তথ্যের অবাধ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ ৩.২.১ ধারায় বলা হয়েছে ‘অনুষ্ঠানে সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনভাবেই দেশবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না।’ এ বিষয়ে দ্বিমতের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু কোন তথ্য ‘দেশবিরোধী’ বা ‘জনস্বার্থবিরোধী’ এটা ঠিক করবে কে? স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায় সরকার একাই এসব বিষয়ে বিধি নিষেধ আরোপ করে কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণমাধ্যমগুলোই দেশের সংবিধানের আলোকে বিষয়গুলো বিবেচনা করে। কিন্তু আলোচিত নীতিমালা এ দায়িত্ব গণমাধ্যমের কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছে। পরের ধারাটিতে (৩.২.২) বলা হয়েছে ‘আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে কোন প্রকার বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত দেয়া পরিহার করতে হবে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে সব পক্ষের যুক্তিসমূহ যথাযথভাবে উপস্থাপনের সুযোগ থাকতে হবে।’ সম্প্রচার মাধ্যমগুলো নিজ দায়িত্বেই এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবে এবং বর্তমানেও তারা এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। এসব বিষয়ে তাদের লাইসেন্স নীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। গণমাধ্যমকে অবশ্যই ‘অসত্য’ তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি কখনও অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয় তবে তা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করা হয় এবং ক্ষমা চাওয়া হয়। ‘বিভ্রান্তিকর’ তথ্যের ক্ষেত্রে আমাদের সংসদে বিতর্কের নামে যা চলে তার সঙ্গে কি তুলনা করা যায়? প্রায়ই সরকার নিজেই অর্ধসত্য এবং মাঝে মাঝে ডাহা মিথ্যা তথ্য প্রচার করে। ৩.২.৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান যেমন: রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের ভাষণ, জরুরি আবহাওয়া বার্তা, স্বাস্থ্য বার্তা, গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা, প্রেস নোট ও অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান জনস্বার্থে যথাযথভাবে সম্প্রচার/প্রচার করতে হবে।’ আমরা সব সময়ই প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সম্প্রচার করি। কিন্তু জরুরি আবহাওয়া বার্তা, স্বাস্থ্য বার্তা, প্রেস নোট এবং অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের বিষয়গুলো আরোপ করার কোন প্রয়োজনীয়তা দেখি না। সম্প্রচার মাধ্যমগুলো দর্শক আকৃষ্ট করার তাগিদেই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্প্রচার করে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এ জন্য এ ধরনের নীতিমালার প্রয়োজন নেই। ৩.৫.১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘স্বেচ্ছাভিত্তিক কাজ ও উন্নয়ন কার্যক্রম প্রচার করতে হবে।’ কিন্তু কেন? প্রতিটি চ্যানেল তাদের দর্শকদের কথা মাথায় রেখে সম্প্রচারের বিষয়বস্তু ঠিক করবে। সব চ্যানেলে কেন একই ধরনের বিষয়বস্তু চাপিয়ে দেয়া হবে। এ নীতিমালা উন্নয়ন কর্মকা-, বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম, খেলাধুলা এবং শিক্ষামূলক প্রোগ্রামের মতো বিষয়গুলো নিয়েও কথা বলেছে। এ নীতিমালার আরেকটি বিপজ্জনক দিকটি হলো এখানে বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তুর (Content) ওপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কি ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে আর কি যাবে না সে বিষয়ে একটা গাইডলাইন বর্তমানে আছে। কিন্তু বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তুর সুক্ষাতিসুক্ষ দিকগুলো নিয়ে নীতিমালা আরোপ করা হলে তা বিজ্ঞাপনের স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করবে। এর ফলে সম্প্রচার মাধ্যমগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক ও দুর্বল হয়ে পড়বে। আর বর্তমানে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এমন কোন বিজ্ঞাপন দেখানো হয় না, যা প্রতিরোধে কোন নীতিমালা প্রয়োজন। ষষ্ঠ অধ্যায়ে সম্প্রচারের অন্য দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ অধ্যায়ে এমন কিছু ধারা আছে যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ক্ষুণœ করতে পারে। ধারা ৫.১.৪: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে এমন ধরনের সামরিক, বেসামরিক বা সরকারি তথ্য প্রচার করা যাবে না। আমরা সেনাবাহিনী সম্পর্কিত তথ্যের স্পর্শকাতরতার বিষয়ে ভালভাবেই অবগত। কিন্তু বেসামরিক এবং সরকারি তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার করা যাবে না কেন? ধারা ৫.১.৫: কোন অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপনে সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোন সংস্থা এবং অপরাধ রোধ, অনুসন্ধান ও তদন্ত এবং অপরাধীকে দ- প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের প্রতি কটাক্ষ বা বিদ্রƒপ কিংবা তাদের পেশাগত ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে পারেÑ এমন কোন দৃশ্য প্রদর্শন কিংবা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। এ নীতিমালার অন্তঃসারশূন্যতা কি ভয়াবহ! আজ যদি এই নীতিমালা বলবৎ থাকতো তাহলে আমরা দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এনএসআই এবং ডিজিএফআই’র সংশ্লিষ্টতা (যা অভিযুক্তরা নিজেরাই স্বীকার করেছে) নিয়ে মুখ খুলতে পারতাম না। এ নীতিমালা অনুযায়ী, আমরা ২১শে আগস্টের ঘটনা নিয়ে কিছু লিখতে পারতাম না, যেখানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় পুলিশের তিন সাবেক মহাপরিদর্শক, দুইজন সাবেক এনএসআই প্রধান, তিনজন সাবেক সিআইডি কর্মকর্তা এবং সেনাবাহিনীর কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনও করা হয়েছে। নতুন এই নীতিমালা অনুসারে আমরা পুলিশ কাস্টডিতে অথবা পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যু, সামরিক বাহিনী, র‌্যাব, ডিজিএফআই, গোয়েন্দা সংস্থা ও দ- দানে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও আইনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবো না। এই নীতিমালা কার্যকর হলে আমরা নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় জড়িত র‌্যাব কিংবা মিরপুরে ঝুট ব্যবসায়ীকে নির্যাতন করে হত্যাকারী মিরপুর থানা সাব-ইন্সপেকটরের বিরুদ্ধে কিছুই লিখতে পারবো না। আমরা ক্রসফায়ার কিংবা রিমান্ডে নির্যাতন নিয়ে কিছু প্রকাশ করতে পারবো না। লিমনের মতো নিরীহ নিরপরাধ ছেলে কখনই ন্যায় বিচার পেত না যদি না গণমাধ্যম র‌্যাবের মুখোশ উন্মোচ করত। র‌্যাব নিরপরাধ লিমনকে গুলি করে পঙ্গ করে দেয় উপরন্তু তাকে সন্ত্রাসী সাজানোর নাটকও করে। গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, পুলিশি নির্যাতনের সকল খবর আমরা এখনও সম্প্রচার করতে পারি না কারণ তা এসব বাহিনীর পেশাগত ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করবে। প্রকৃতপক্ষে, এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য গণমাধ্যমকে নিজ দায়িত্ব পালন করা থেকে ব্যাহত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। ধারা ৫.১.৯: জনস্বার্থ বিঘিœত হতে পারে এমন কোন বিদ্রোহ, নৈরাজ্য এবং হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন পরিহার করতে হবে ‘বিদ্রোহ’ বিষয়টি আমরা বুঝি এবং কিভাবে তার সম্প্রচার করা হবে তা নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে। কিন্তু ‘নৈরাজ্য’ এবং ‘হিংসাত্বক’ বলতে কি বোঝানো হচ্ছে? এই নীতিমালা অনুযায়ী আমরা সহিংসতা এবং গোলযোগের ঘটনা প্রচার করতে পারবো না। মনে হচ্ছে যখন দুষ্কৃতকারীরা রেললাইন উপড়ে ফেলবে অথবা আমাদের কারখানা জ্বালিয়ে দেবে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তখন নাচ গান দেখানোতেই ব্যস্ত থাকবে। ২০১৪ সালের নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত যখন চলন্ত বাসে বোমা নিক্ষেপ করছিল অথবা ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ তথাকঠিত ‘লগি-বৈঠা’র আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা ঘটিয়েছিল তা যথাযথভাবে তুলে ধরা কি ভুল ছিল? ভবিষ্যতে কি এসব ঘটনা আর প্রচার করা যাবে না? আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিরোধী দলগুলো সর্বদাই আন্দোলনের কর্মসূচি দেয় এবং প্রায়শই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সরকার নীতিমালায় নৈরাজ্য ও সহিংসতার ঘটনা প্রদর্শন করা যাবে না বলে প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলের কর্মসূচির খবর প্রচার বন্ধ করতে চায়। কয়েকদিন আগে বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর যে পুলিশি নির্যাতন করা হলো এই নীতিমালা অনুযায়ী কি তা প্রচার করা যাবে না? ধারা ৫.১.৭: কোন বিদেশী রাষ্ট্রের অনুকূলে এমন ধরনের প্রচারণা যা বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে বিরোধের কোন একটি বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে অথবা একটি বন্ধু ভাবাপন্ন বিদেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন ধরনের প্রচারণা যার ফলে সে রাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে এমন দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। এই ধারা অনুযায়ী মিয়ানমার কর্তৃক ২০০৭/৮ সালে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় যুদ্ধজাহাজ প্রেরণের ঘটনার অনুরুপ কোন ঘটনা অথবা সীমান্তে ফেলানির হত্যাকা-ের মতো ঘটনা বা নিয়মিতভাবে সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যার ঘটনা ভবিষ্যতে আর প্রচার করা যাবে না। তিস্তায় আমাদের ন্যায্য হিস্যার ব্যাপারে ভারতের উদাসীনতা নিয়ে কি লেখা যাবে? এই নীতিমালা অনুযায়ী, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় সৌদি আরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া অথবা অন্য কোন দেশে যেখানে আমাদের শ্রমিকরা খুন, নির্যাতন, ধর্ষণ অথবা অবৈধ আটকাদেশের শিকার হচ্ছে তা নিয়ে খবর প্রচার করতে পারবো না? তাহলে আমাদের শ্রমিকেরা যাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভিত্তি করে আমরা রেকর্ড রিজার্ভের গর্ব করছি তারা কি বিদেশী রাষ্ট্রের কৃপা অথবা আমাদের দেশের ভীতু এবং কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজ কমার্শিয়াল এটাশিদের কৃপার ওপর নির্ভর করবে? ধারা ৪.২.৮: বিজ্ঞাপনে পরিবেশবান্ধব নয় এমন কোন দৃশ্য প্রচার পরিহার করতে হবে। দূষিত নদী, যত্রতত্র ফেলে রাখা আবর্জনা অথবা নির্বিচারে গাছ কাটা প্রভৃতি দৃশ্য তুলে ধরে জনগণকে এসব কাজ থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সচেতন থাকতে বলায় দোষের কি আছে? সর্বোপরি এই নীতিমালায় স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতি যে ধরনের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তা ইতিহাস বিরুদ্ধ ও স্বাধীনতার পথে মানুষের অগ্রযাত্রার প্রতিবন্ধক। গণতন্ত্রের অধীনে গত তিন দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নে স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকাকে সরকার ভুলভাবে এবং অবহেলার সঙ্গে বিবেচনা করছেন। এখানে আমি অমর্ত্য সেনের লেখার দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন কিভাবে বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা উন্নয়নে অবদান রাখে। তাঁর যুগান্তকারী বই ‘উন্নয়ন ও স্বাধীনতা’ আমাদের নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি উন্মোচনে সহায়ক হবে। ধারা ৭.১: এ সম্প্রচার নীতিমালার আলোকে প্রতিটি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানকে সুনির্দিষ্ট Charter of duties ও সম্পাদকীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যা কোনমতেই সম্প্রচার নীতিমালার পরিপন্থি হতে পারবে না ও কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত হবে। এই প্রস্তাব গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকি স্বরূপ। এটা প্রকৃতপক্ষে গণমাধ্যমের ‘সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ও অন্যান্য কার্যক্রমের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। এর ফলে সম্পাদকগণ ও গণমাধ্যমকর্মীরা স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে চ্যানেলগুলো পরিচালনা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এটা মন্ত্রণালয়কে (পড়–ন আমলা ও তাদের রাজনৈতিক প্রভু) গণমাধ্যমের কার্যক্রমে সরাসরি নাক গলানোর সুযোগ করে দেবে। ধারা ৭.৩: কোন অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন শোভনীয়, সুন্দর, সুরুচিপূর্ণ ও পরিমার্জিত কিনা এ বিষয়ে কোনরূপ দ্বিধা/সন্দেহ দেখা দিলে সম্প্রচার মাধ্যমকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এ প্রস্তাবটি যারা তৈরি করেছেন তাদের কোন ধারণাই নেই সম্প্রচার মাধ্যম কিভাবে কাজ করে। ধরেন, প্রতিটি গণমাধ্যম কি ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করবে তার জন্য প্রত্যেকবার ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের’ কাছে নিয়ে যাবে। এটা দেখে মনে হয় টেলিভিশনে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের বিজ্ঞাপনের যথার্থতা নিয়ে কোন ধারণা নেই আর আমলারা যাদের সম্প্রচার মাধ্যমের কর্মকা- বিষয়ক কোন জ্ঞান নেই তারাই বিজ্ঞাপন বিষয়ে সর্বজ্ঞ। ধারা ৭.৪: এ নীতিমালায় উল্লেখ নেই অথবা অন্য কোন নীতিমালা বা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত প্রদান করবে। এটি একটি অন্তঃসারশূন্য (vague) প্রস্তাব যা বিস্তৃত বিষয় নিয়ে কথা বলছে। ‘অন্য কোন নীতিমালার আওতায় কি কি নীতিমালা বিবেচিত হচ্ছে আমরা তা জানি না। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব নীতিমালা থাকতে পারে। গণমাধ্যম কতগুলো নীতিমালা অনুসরণ করবে। তথ্য মন্ত্রণালয় আমলাতন্ত্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট অনুযায়ী এসব নীতিমালার এমন ব্যাখ্যা দেবে যা জনগণের জানার অধিকারকে ক্ষুণœ করবে। এই প্রস্তাবটি স্বাধীন গণমাধ্যমের কর্মকা-কে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ধারা ৭.৫: সম্প্রচার ও সম্প্রচার কমিশন সম্পর্কিত আইন, বিধিমালা এবং নীতিমালা প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত তথ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রচার সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এটা কোনভাবেই স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য সহায়ক নয়। আধুনিক দর্শকদের রুচি ও চাহিদা এই নীতিমালায় আরেকটি গুরুতর বিষয় রয়েছে যা নিয়ে এখনও গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয় না। এই নীতিমালা বা এর সঙ্গে দূরবর্তীভাবে সম্পর্কিত কোন নীতিমালাও যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে আমাদের সম্প্রচার মাধ্যমগুলো একঘেয়ে ও বিরক্তিকর (dull and gloomy) হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার অভাবে আমাদের চ্যানেলগুলো যে সব প্রোগ্রাম তৈরি করবে তা বর্তমান কালের দর্শকদের মন যোগাতে ব্যর্থ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ দর্শকরা এখন অনেক গতিশীল ও চাহিদা সম্পন্ন। এই ডিজিটাল যুগের তরুণদের ক্ষেত্রে একথা আরও বেশি প্রযোজ্য। তারা একঘেয়ে ও বিরক্তিকর চ্যানেল ছেড়ে আনন্দদায়ক ও বিনোদনমূলক চ্যানেলে যেতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। এর ফলে আমাদের দেশের দর্শকরা দেশী চ্যানেল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে এবং বিদেশী চ্যানেলগুলোর প্রতি আর ঝুঁকে পড়বে। আমাদের দেশে এসব বিদেশী চ্যানেল ইতিমধ্যেই খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশী চ্যানেলগুলো আধুনিকায়নের মাধ্যমে এই প্রবণতা অনেকটা রোধ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই নীতিমালার ফলে দর্শকদের মত বিজ্ঞাপনদাতারও দেশী চ্যানেলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এভাবেই প্রস্তাবিত নীতিমালার দেশীয় সম্প্রচার মাধ্যমগুলোকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিবে। পরিশেষে বলতে চাই আমরা সম্প্রচার নীতিমালার বিরুদ্ধে নই। আমরা এমন আইন চাই যা স্বাধীনতাকে লালন করবে এবং গণমাধ্যমেকে একটি শক্তিশালী শিল্পখাত হিসেবে গড়ে তুলবে যেখানে একটি নৈতিক এবং স্বাধীন গণমাধ্যম সর্বোচ্চ নৈতিকতা বজায় রেখে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে। আমরা মনে করি এরকম একটি আইন তৈরি করতে প্রথমেই একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করা উচিত। সাংবাদিক সমিতিগুলো এবং সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর সমিতি এ্যাকটোও এ বিষয়ে একমত। যারা সকল অংশীজনকে সঙ্গে নিয়ে এই আইনটি তৈরি করবে। এখানে অংশীজনরা অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হবেন। অবিলম্বে স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করুন এবং তাদেরকেই নীতিমালাটি তৈরি করতে দিন। আমরা শুরুর ন্যায় শেষেও একই কথা বলতে চাই। সরকার সাময়িকভাবে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত স্বাধীন গণমাধ্যমেরই জয় হবে।
মাহফুজ আনাম: সাধারণ সম্পাদক, সম্পাদক পরিষদ এবং সম্পাদক ও প্রকাশক, দি ডেইলি স্টার

No comments

Powered by Blogger.