পানি নিয়ে ভাবনা by মিখাইল গর্বাচভ

এই মে মাসে ভিয়েতনাম ৩৫তম দেশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য ল অব নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কোর্সেসে সই করেছে। ফলে, ৯০ দিন পর আগামী ১৭ আগস্ট এই রীতি কার্যকর হবে। এই রীতির খসড়া প্রস্তুতকরণ ও প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেতে প্রায় ৫০ বছর লেগে গেল। এতে বোঝা যায়, আধুনিক বহুপক্ষীয় সমঝোতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে। আন্তসীমান্তীয় পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনায় বহুদিনের মতানৈক্য রয়েছে। আবার আন্তর্জাতিক আইনের বদলে সরকার ও পানিবিদেরা অববাহিকা মতৈক্যের ওপর আস্থাশীল। এ দুটি বিষয় ছাড়াও আরেকটি দিক আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়—৫০ বছরের অপেক্ষার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব। এটির স্বীকৃতি নিয়ে দুনিয়ায় উৎসব বা উদ্‌যাপন হতে পারে, কিন্তু আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকা চলবে না।
দুনিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ মিঠাপানি একাধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ কোনো না কোনো অববাহিকাসংক্রান্ত মতৈক্যের মধ্যে আছে। দুনিয়ায় পানি নিয়ে বিবাদের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে, পানি বণ্টনের আয়োজনও ক্ষমতার খেলায় অন্যতম ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের ভেতরে ও দেশগুলোর মধ্যে পানি বণ্টন নিয়ে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। একদিকে পানি নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে, অন্যদিকে এর ফলে বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
কিন্তু সবচেয়ে খারাপ খবর হচ্ছে, দুনিয়ায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে পানি ব্যবহারের পরিমাণ অধিক হারে বাড়ছে। বিংশ শতাব্দীতেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে পানি ব্যবহারের হার দ্বিগুণ বেড়েছে। জাতিসংঘের একাধিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে দুনিয়ার প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মানুষ চরম পানিস্বল্পতার মুখে পড়বে। অর্থাৎ, মানবীয় ও পরিবেশগত ব্যবহারের ক্ষেত্রে পানির  সংকট সৃষ্টি হবে। তার পরও দুনিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ পানি ব্যবহারে চাপে পড়বে, তার মানে নবায়নযোগ্য মিঠাপানির সংকটের মুখে পড়বে।
শক্তিশালী পাল্টা ব্যবস্থা না নেওয়া হলে দুনিয়ার অনেক সমাজই পানির চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে না। এর ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশান্তরি হতে বাধ্য হবে, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে, সমাজে অস্থিরতা ও সহিংসতা বাড়বে। ফলে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
জাতিসংঘের পানিবিষয়ক রীতিটিকে উপেক্ষা করা চলবে না, এটাকে ফাইলবন্দী করে ড্রয়ারে ঢোকানো হলে বিপদ আছে। আজকের এই জলবায়ু পরিবর্তন, ঊর্ধ্বগামী চাহিদা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দূষণ বৃদ্ধি সম্পদের অতি ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে দুনিয়ার পানিসম্পদ ব্যবহারের আইনি কাঠামোটিকে আরও জোরদার করতে হবে। আমাদের পরিবেশগত নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা এর ওপর সরাসরি নির্ভরশীল।
এই রীতিতে স্বাক্ষরকারী সব দেশের আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রে এটি শিগগিরই প্রযোজ্য হবে, শুধু বড় বড় অববাহিকার ক্ষেত্রে নয়। বিদ্যমান মতৈক্যের ক্ষেত্রে যে ফাঁকফোকর রয়ে গেছে, সেগুলো পূরণে এটি সহায়তা করবে। আর যে আন্তর্জাতিক নদীগুলো চরম চাপের মুখে রয়েছে, সেগুলোও একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে চলে আসবে।
দুনিয়ায় ২৭৬টি আন্তর্জাতিক অববাহিকা রয়েছে। পর্যাপ্ত অর্থায়ন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অংশীদারদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে পানিসংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। কিন্তু এ রকম হওয়া কি সম্ভব?
সময় এসেছেে একটি উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি গ্রহণ করার। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) নিয়ে আলোচনা করছে। আমরা গ্রিন ক্রসের পক্ষ থেকে আশা করছি, নতুন উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি একক লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা হবে, যেখানে পানিসম্পদ ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হবে। এটা অর্জনের সময়সীমা হচ্ছে ২০৩০ সাল।
তার পরও কিয়োটো প্রটোকল বাদ দিয়ে একটি নতুন জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। পানির চক্রের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোয় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বৃষ্টিপাতের ধরনকে স্বাভাবিক করতে সহায়তা করবে। দুনিয়ার নানা স্থানে পানির যে চরম সংকট রয়েছে, সেটার মোকাবিলাও সম্ভব হবে।
কিন্তু জাতিসংঘের জলপথ আইনটি কার্যকর হওয়ার প্রাক্কালে এমন সব প্রশ্নের উদয় হচ্ছে, যেগুলোর অস্তিত্ব এটি গ্রহণের আগেও ছিল। এটি বাস্তবায়নের ব্যবহারিক ফল কী হবে? দেশগুলো কীভাবে নিজেদের দেশের ভেতরে বা নদীতীরের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই আইন ব্যবহার করবে? আমেরিকান ও এশিয়ান যে দেশগুলো আইনটি অনুমোদনে গড়িমসি করেছে, তারা কীভাবে সাড়া দেবে?
আর এই আইনের সঙ্গে কনভেনশন অন দ্য প্রোটেকশন অ্যান্ড ইউস অব ট্রান্সবাউন্ডারি ওয়াটার কোর্সেস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল লেকস-এরই–বা কী সম্পর্ক হবে? ইউরোপ ও কেন্দ্রীয় এশিয়ার অনেক দেশেই আইনটি ২০১৩ সাল থেকে বলবৎ​ আছে। এর সদস্যপ্রাপ্তির দরজাও খোলা রয়েছে। একইভাবে, এ রীতি কার্যকর হলে বিদ্যমান ও আন্তদেশীয় মতৈক্যগুলোর ওপর এর কী প্রভাব পড়বে?
যে দেশগুলো এই রীতিতে স্বাক্ষর করেছে, তাদের ওপর কিছু দায়িত্ব বর্তায়: আন্তদেশীয় পানি টেকসইভাবে ব্যবহার করা এবং তা রক্ষা করা। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে, যেমন আর্থিক বিষয়ে এই রীতিতে কী বলা আছে?
একাধিক আইন একত্রে বা একসূত্রে গেঁথে বাস্তবায়ন করা যায়, যেমন: রামসার কনভেনশন অন দ্য ওয়েটল্যান্ড, জাতিসংঘের কনভেনশন টু কমব্যাট ডেসারটিফিকেশন ও জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ—অনেকগুলোর মধ্যে কিছু নাম উল্লেখ করা গেল। জাতিসংঘের জলপথরীতিটি অন্যান্য দেশের সামনে অনেক বিলম্বে কার্যকর হওয়ার এক নতুন সুযোগ এসেছে, তারা এখন সহযোগিতামূলক মতৈক্য গঠন নিয়ে আন্তরিকভাবে ভেবে দেখতে পারে।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে শুধু রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিকদের পক্ষে দুনিয়ার সব সমস্যা নিয়ে কার্যকরভাবে মাথা ঘামানো সম্ভব নয়। প্রয়োজন হচ্ছে সব পক্ষের অংশগ্রহণ: রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ। জাতিসংঘের জলপথরীতিটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে এদের সবারই অংশগ্রহণ লাগবে।
এটা অনেক সময়ই উপেক্ষা করা হয়। যূথবদ্ধতার দীর্ঘমেয়াদি সফলতার জন্য এর প্রয়োজন রয়েছে, এতে সবারই ভালো হয়। অংশীদারদের সবার অংশগ্রহণ (আক্রান্ত সম্প্রদায়সহ), চিহ্নিতকরণের সক্ষমতা বৃদ্ধি, মূল্য, আন্তদেশীয় পানির সুফল ভোগ এই ব্যাপারগুলো যেকোনো যৌথ কর্মসূচিতে থাকতে হবে, বহুপক্ষীয় সহযোগিতার কার্যকারিতার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

মিখাইল গর্বাচভ: সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী।

No comments

Powered by Blogger.