প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে ন্যায়পাল চাই by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

সাংবাদিক এ কে এম জাকারিয়া যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন: ‘রাজনীতিকদের নিষিদ্ধ করার বোর্ড কই?’ (প্রথম আলো, ৯ জুলাই ২০১৪) কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড’ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জনাব জাকারিয়া এই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি আরও লিখেছেন:‘ক্রিকেটের চেয়ে নিশ্চয় দেশ বড়। বিসিবির মতো প্রতিষ্ঠান আছে বলে হয়তো সাকিবের মতো খেলোয়াড়ের আচরণের ‘সমস্যা’ দূর করার চেষ্টা হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে অন্যদের সতর্ক করা হবে। এর মধ্য দিয়ে হয়তো দেশের ক্রিকেট বাঁচবে, কিন্তু দেশ বাঁচাবে কে?’

রাজনীতিবিদদের জন্য এ রকম কোনো ‘শৃঙ্খলা বোর্ড’ নেই বলে লেখক আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। রাজনীতিবিদেরা হয়তো বলবেন: ‘কেন, আমরা যে পাঁচ বছর অন্তর ভোটে যাই, সেটাই তো আমাদের বোর্ড। জনগণ আমাদের প্রত্যাখ্যান করলে তো আমরা আর ক্ষমতায় থাকতে পারি না। সেটাই তো আমাদের শাস্তি।’

কথাটা আংশিক সত্য, পুরোটা নয়।এটা ঠিক যে পাঁচ বছর পর রাজনীতিকদের ভোটারের সামনে দাঁড়াতে হয়। একবার অন্তত পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ভোটও আর পরীক্ষার পর্যায়ে নেই। একসময় নকল করে পরীক্ষায় পাস করা যেত। কিন্তু গত ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার আর নকলের ব্যবস্থাও রাখেনি, রীতিমতো পরীক্ষা ছাড়াই পাসের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এরপর উপজেলা নির্বাচন ও নারায়ণগঞ্জ উপনির্বাচনে ‘পরীক্ষার’ যে শ্রী সবাই দেখেছেন, তাকে আর ‘পরীক্ষা’ বলা যায় কি না সন্দেহ। আশঙ্কা হয়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে নির্বাচন ব্যাপারটি এ রকমই প্রহসনমূলক হবে।

রাজনীতিবিদেরা যখন বলেন, প্রতি পাঁচ বছর পর জনগণের সামনে তাঁদের পরীক্ষা দিতে হয়, তখন অর্ধসত্য বলেন। কারণ, আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন হয় না। অন্তত ৯০ শতাংশ কেন্দ্রে নির্বাচন হয় নির্বাচনী প্রতীকের ভিত্তিতে। যেখানে কে প্রার্থী, তা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। জনগণও ভোট দেন প্রতীকে, প্রার্থীকে নয়। কাজেই পাঁচ বছর পর খুব কম ব্যক্তিকেই জনগণের সামনে পরীক্ষা দিতে হয়। বলা যায়, তাঁর দলকে পরীক্ষা দিতে হয়। ব্যক্তিকে নয়।

আমাদের দেশের অগ্রগতি বা উন্নয়নে অনেক দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের (মন্ত্রীর ভূমিকায়) বিরাট অবদান রয়েছে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও রাজনীতিক, ছাত্র ও তরুণদের বিরাট অবদান রয়েছে। এ কথা মুহূর্তের জন্যও বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। তবু এ কথা বাস্তব সত্য যে বাংলাদেশ যে আজ এতটা পিছিয়ে পড়েছে, তার জন্য প্রধানত শাসক রাজনীতিকেরাই দায়ী। বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে সত্য। কিন্তু ৪৩ বছরে বাংলাদেশের যে অবস্থানে থাকা উচিত ছিল, সেই অবস্থানে যেতে পারেনি।

এখানে নব্বই-পূর্ববর্তী সরকারগুলো নিয়ে আলোচনা করছি না।অতি সংক্ষেপে নব্বই-পরবর্তী সরকারগুলোর কথা বলা যেতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার, জাতীয় সংসদ পরিচালনা, নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক সংস্থা গঠন, প্রধানমন্ত্রীর অত্যধিক ক্ষমতা, রাষ্ট্রপতিকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা, সরকার পরিচালনায় বিরোধী দলের ভূমিকা, সরকারি প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা, সামরিক বাহিনী পরিচালনা, দেশের উচ্চশিক্ষা অঙ্গন, স্থানীয় সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রীড়াঙ্গন, গণমাধ্যম—দেশের এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুসরণ করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল (বড় দুটি দলই) তাদের দলের নেতাদের স্বার্থ রক্ষাকারী ‘নিয়ম’ অনুসরণ করেই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সরকার ও সরকারি দলের স্বার্থে যা যায় সেটাই নিয়ম, সেটাই শৃঙ্খলা। তবে কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে।গত ২৫ বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে টিআইবি যেসব রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তা কিসের সাক্ষ্য দেয়? নিয়ম-শৃঙ্খলা? নাকি দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা?

দেশে নানা সরকারি প্রতিষ্ঠানে এত অনিয়ম যাঁরা করেছেন, তাঁদের নামে কোন ‘বোর্ডে’ নালিশ করবে জনগণ? কোন ‘শৃঙ্খলা কমিটি’ তাদের শাস্তি দেবে? দিতে পারব? অনেকেই বলবেন, কেন, আদালত রয়েছেন না? ঠিক, আদালত তো রয়েছেন। কিন্তু সব বিষয়ে কি আদালতে যাওয়া যায়? যাওয়ার মতো বিষয়? আদালতে গেলেই যে একজন সুবিচার পাবেন, তার নিশ্চয়তা আছে কি? তা ছাড়া আমাদের আদালতে এত মামলার জট। বিচার হতে ও রায় পেতে এক যুগও লেগে যেতে পারে। এক যুগ পরে সেই বিচার ও রায়ের সার্থকতা কোথায়?

‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি’ হলে তাঁর সাত খুন মাফ, এই ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে যা যা করণীয়: (১) নতুন নির্বাচনী আইন করতে হবে, নির্বাচনী এলাকার ৫১ শতাংশ ভোটার নির্বাচন কমিশনে আবেদন করলে সেই এমপির সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে এবং সেই পদে পুনর্নির্বাচন করতে হবে। (২) সংরক্ষিত নারী আসন বলে কিছু থাকবে না। প্রতিটি পদেই প্রত্যক্ষ নির্বাচন করতে হবে। (৩) নির্বাচনে ‘না ভোট’ আবার প্রবর্তন করতে হবে। (এর ফলে কলাগাছকে আর প্রার্থী করা সম্ভব হবে না।) (৪) প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে এবং তার ব্যত্যয় ঘটলে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে শাস্তি পেতে হবে। (৫) প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে একজন ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ দিতে হবে। অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি মন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করবেন, সেই সুপারিশ মানতে নৈতিকভাবে মন্ত্রী বাধ্য হবেন। সংসদের বিরোধী দল প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের ন্যায়পালের নাম প্রস্তাব করবে। (৬) দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ঢেলে সাজাতে হবে। সাবেক সরকারি আমলা দিয়ে নয়, সাবেক বিচারক দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্বিন্যাস করতে হবে।

বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নেই কোনো শৃঙ্খলা বা গণতন্ত্র। বড় তিনটি দল চলছে ‘প্রাইভেট কোম্পানির’ মতো। ম্যানেজিং ডিরেক্টর (সভাপতি) যা বলেন, সব নেতাকে তা ‘জি হুজুর’ বলে মেনে চলতে হয়। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা স্টাফ অফিসারের মতো। দলের বিভিন্ন কমিটিও হয় নেত্রীর ইচ্ছায়। অথচ দলের গঠনতন্ত্রে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা লেখা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন দেখতে পারত দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালিত হচ্ছে কি না। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা ও রাজনৈতিক দলকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন কি এর কোনোটিই করতে পেরেছে? সেই নির্বাচন কমিশন আমরা কবে পাব, কীভাবে পাব?

‘অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হবে’—এটা শুধু ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের জন্য প্রযোজ্য হবে, আর কারও জন্য প্রযোজ্য হবে না, এটা হতে পারে না। অন্যায়ের জন্য সবাইকে শাস্তি পেতে হবে—এ রকম একটা পরিস্থিতি দেশে সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান সরকারের পক্ষে সেই পরিস্থিতি বা কাঠামো সৃষ্টি করা সম্ভব বলে মনে হয় না।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.