গাজায় নিরাপদ আশ্রয় নেই

গাজা উপত্যকার রাফায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় বিধ্বস্ত
বাড়ির সামনে এক ফিলিস্তিনি নারীর আহাজারী।
শুক্রবার, সকাল সাতটা। গাজায় নিজ বাড়ির সিঁড়ির নিচে পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. কাদের। হঠাৎ প্রতিবেশীর ভয়ার্ত কণ্ঠের ডাক, ‘ড. কাদের, উঠুন, উঠুন। তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ওরা আমার বাড়িতে বোমা হামলা চালাতে যাচ্ছে।’ সন্তানদের তাড়াহুড়া করে জাগিয়ে তাদের নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে যাচ্ছিলেন ড. কাদের। সে সময় সাত বছর বয়সী ছোট ছেলে মোহাম্মদ বাবার পরনের পোশাক খামচে ধরল। এই তাড়াহুড়ায় ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে সে, যেন নড়াচড়া করতে পারছে না! তাকে কোলে নিয়ে সবাই মিলে দ্রুত বাড়ি ছাড়লেন কাদের। হলুদ রঙের এই বাড়িটি তৈরি করতে বেশ কয়েক বছর কষ্ট করে অর্থ জমাতে হয় কাদেরকে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের গগনবিদারী আওয়াজ শুনতে পেলেন তিনি। ‘হামলা থেকে বাঁচার জন্য আমরা শুধু দৌড়াতে লাগলাম।’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলছিলেন কাদের। তিনি বলেন, ‘এমন হামলা আমার সন্তানের মনে স্থায়ী আতঙ্কের ছাপ ফেলছে—এই শৈশব কি তাদের প্রাপ্য?’ ড. কাদেরের বাড়ি ইসরায়েলি বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল না। কিন্তু তাঁর প্রতিবেশীর বাড়ি লক্ষ্যবস্তু ছিল। সন্তানদের নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছার পরপরই ইসরায়েলি বিমান থেকে ফেলা দ্বিতীয় ক্ষেপণাস্ত্রে বিধ্বস্ত হলো প্রতিবেশীর বাড়ি। ড. কাদেরের পাঁচ সন্তানের বয়স সাত বছর থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। পাশের বাড়ি বোমায় বিধ্বস্ত। এখন ভয়ে নিজের বাড়িতে ফিরতে চাচ্ছে না কাদেরের সন্তানেরা। ‘বাচ্চারা এত ভীত যে বাড়ি ফিরতে চাচ্ছে না, আমরা তো সেদিন আসলে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম।’ বলেন কাদের। কাদের যে হামলার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, সেই হামলার সময়ই গাজার দক্ষিণাঞ্চলে রাফায় আরেকটি বাড়িতে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল।
হামলার আগে কোনো সতর্কসংকেত পায়নি ওই বাড়ির লোকজন। ওই হামলায় ঘুমন্ত অবস্থায় একই পরিবারের পাঁচজন প্রাণ হারান। আহত হন ১৬ জন। গাজায় টানা সাত দিনের ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১৭২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন এক হাজারের বেশি। জাতিসংঘের তথ্যমতে, নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। হামলায় এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের অন্তত ৭০টি বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আড়াই হাজারের বেশি বাড়ি। ইসরায়েল গাজার প্রায় প্রতিটি স্থানেই হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এই নির্বিচার হামলার পক্ষে সাফাই গাওয়ারও চেষ্টা করছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে খুদে ব্লগ লেখার ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, ফিলিস্তিনের কট্টরপন্থী সংগঠন হামাস রকেট ও বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ‘বিভিন্ন বাড়ি, মসজিদ, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে’ লুকিয়ে রেখেছে। তাই বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানো হচ্ছে। ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, বেসামরিক হতাহত এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টাই করছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিন হিউম্যান রাইটস সেন্টারের উপপরিচালক জাবে উইসা বলেন, ইসরায়েল গাজার বিভিন্ন বাড়িতে ‘ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক’ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো বাড়ির মালিক হামাস বা ইসলামিক জিহাদের সদস্য হলেও সেই বাড়িকে বেসামরিক স্থাপনা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে সে বিষয়টি বিবেচনায়ই নেওয়া হচ্ছে না। উইসা আরও বলেন, বিমান হামলা চালানোর আগে কোনো সতর্কসংকেতও দিচ্ছে না ইসরায়েল। ওই বাড়িগুলোতে থাকা পরিবারের সদস্যদের সরে যাওয়ার সুযোগ দিতে হামলার আগে সতর্কসংকেত দেওয়া উচিত ইসরায়েলের। তিনি বলেন, আসলে গাজার প্রতিটি বাড়ি লক্ষ্যবস্তু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এখানে এখন আর নিরাপদ আশ্রয় বলতে কিছু নেই। বিমান হামলায় গাজার প্রতিটি বাড়িই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আল–জাজিরা।

No comments

Powered by Blogger.