দুঃখী ম্যারাডোনার পাশে মেসি

নিয়তি মানুষকে নিয়ে কি খেলাটাই না খেলে থাকে। তাই বলে লিওনেল মেসির মতো মানুষকে নিয়েও। মারাকানার মঞ্চে রোববার ফুটবল জাদুকর উঠলেন ঠিকই। তবে বিশ্বকাপ আর ধরা হলো না। সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার হাতে নিলেন যেন নিতান্তই অনিচ্ছায়। এ সান্ত্বনা পুরস্কার তিনি চাননি। তার সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল বিশ্বকাপ। বার্সোলোনা সতীর্থ জাভি, ইনিয়েস্তার কাছে জানতেও চেয়েছিলেন বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখতে কেমন লাগে? সে বিশ্বকাপ থেকে ইঞ্চি কয়েক দূরত্বে থেমে গেলেন তিনি। ম্যাচ শুরুর আগেই ফুটবল পণ্ডিতরা বলেছিলেন, জার্মানিই ফেভারিট। কিন্তু সবার দৃষ্টি ছিল লিওনেল মেসির দিকে। কারণ তারা জানতেন মুহূর্তের মেসি ম্যাজিকে পাল্টে যেতে পারে সব। মহারণের শুরুতে আর্জেন্টিনার নীল জার্সি দেখেই অবশ্য আঁতকে উঠেছিলেন অনেকে। এ তো অভিশপ্ত জার্সি। এ রঙের জার্সি পরে দুই যুগ আগে এই জার্মানির কাছেই ফাইনালে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। এক মাস আগে মারাকানাতেই বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয়েছিল মেসির। তিন ম্যাচে চার স্বর্গীয় গোল। দ্বিতীয় রাউন্ডে এসে গোল না পেলেও দুরন্ত জাদুর প্রদর্শনী অব্যাহতই ছিল। যদিও নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে ছিলেন অনুজ্জ্বল। ফাইনালের শুরুতে আর্জেন্টিনাকে চেপে বসে জার্মানি। মাঝ মাঠ অবধি আসতে কোন বাধাই পাচ্ছিলেন না জার্মান খেলোয়াড়রা। পরে বোঝা গেছে, এটা আসলে সাবেয়ার কৌশলই ছিল। প্রতিপক্ষকে নিজেদের অর্ধে টেনে এনে কাউন্টার অ্যাটাকে যাওয়া। এ থেকে বার বারই সুযোগ তৈরি হচ্ছিল। লিওনেল মেসির ভয়ঙ্কর গতি আর ড্রিবলিংয়ের দেখা মিলছিল। মুহূর্তেই ছিটকে ফেলছিলেন তিন-চার জন মার্কারকে। কিন্তু আসল কাজ হচ্ছিল না। গোলরক্ষককে একা পেয়েও গোল করতে পারলেন না হিগুয়েইন। আরেকবার মেসির জাদুকরি পাস লাভাজ্জি হয়ে হিগুয়েইনের কাছে। তার শট জাল খুঁজেও পেলো। কিন্তু কোটি কোটি আর্জেন্টিনা সমর্থককে স্তব্ধ করে দিয়ে অফসাইডের কারণে এ গোল বাতিল করে দেন রেফারি। জার্মানির বেশির ভাগ আক্রমণই খেই হারিয়ে ফেলছিল আর্জেন্টিনার ডিবক্সে গিয়ে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে গোল মিস করলেন স্বয়ং লিওনেল মেসি। গোলরক্ষককে পরাস্ত করতে পারলেও জালে না ঢুকে বার ঘেঁষে চলে যায় বল। যেন তার বিশ্বকাপ স্বপ্নও বেরিয়ে গেল। অথচ বার্সেলোনার হয়ে এ জায়গা থেকে গোল হররোজই করে থাকেন মেসি। বারবার গোল মিসের মূল্য অবশ্য নির্মমভাবে পরিশোধ করতে হয় আর্জেন্টিনাকে। খেলা শেষ হওয়ার সাত মিনিট বাকি। সবাই ভাবছেন টাইব্রেকারেই নিষ্পত্তি হবে ফাইনালের। কিন্তু মারিও গোটশের ভাবনা ছিল ভিন্ন। ১১৩ মিনিটের মাথায় অসাধারণ এক গোল করে আর্জেন্টিনাকে স্তব্ধ করে দেন এ তরুণ। শেষ কয়েক মিনিটে আর্জেন্টিনা চেষ্টা করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মেসির হেড বারের ইঞ্চি কয়েক উপর দিয়ে চলে যায়। খেলার একেবারে শেষ মুহূর্তে পেনাল্টি এরিয়ার কাছাকাছি ফ্রি কিক পেয়েছিলেন। কিন্তু মেসির নেয়া শট বারের উপর দিয়ে চলে যায়। আর ফুটবলের এক যুবরাজের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নও শেষ হয়ে যায় আপাতত। খেলা শেষে লিওনেল মেসি অবশ্য স্ট্রাইকারদের পাশাপাশি দোষারোপ করেছেন ভাগ্যকেও। ইংরেজিতে বিখ্যাত প্রবাদ- হিস্ট্রি রিপিট ইটসেলফ- ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন হয়। খেলোয়াড়ি জীবনের শুরু থেকে মেসির মধ্যে ম্যারাডোনার ছায়া দেখতে পান অনেকে। অনেক নতুন ম্যারাডোনার মতো হারিয়ে যাননি তিনি। দিনের পর দিন অসাধারণ সব পারফরমেন্স প্রদর্শন করে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছেন এখনই। তবে মারাকানায় জার্মানি-আর্জেন্টিনা ফাইনালের আগে দুই ম্যারাডোনা ফিরছিলেন। ’৮৬’র ম্যারাডোনা উচ্ছ্বসিত। জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্ব জয় করেছিলেন যিনি। পরের ফাইনালে অশ্রুসজল তিনি। এবার জার্মানির সঙ্গে ১-০ গোলে পরাজয়। ম্যাচ শেষে দিয়াগো ম্যারাডোনার সেই কান্নার ছবি স্থান পেয়েছে বিশ্বকাপের চিরস্থায়ী অ্যালবামেও। এবার মারাকানার ফাইনালের আগে সবচেয়ে বিখ্যাত প্রশ্ন ছিল, লিওনেল মেসি কি ম্যারাডোনা হতে পারবেন। সে প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। তিনি ম্যারাডোনা হতে পেরেছেন। তবে তা ’৮৬-এর সুখী ম্যারাডোনা নন। ’৯০-এর দুঃখী ম্যারাডোনার পাশেই স্থান হয়েছে লিওনেল মেসির।

No comments

Powered by Blogger.