রানাপ্লাজা ধস- দ্বিতীয় লড়াইয়ে কিশোরী আন্না by শর্মী চক্রবর্তী

২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল ধসে পড়েছিল সাভারের রানাপ্লাজা। এর ৬ তলায় ১৭ দিন আগে কাজে যোগ দিয়েছিল ১৩ বছরের আন্না। দুর্ঘটনার দিন ওই ভবনে আটকা পড়েছিল সে। বাঁচার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল। সে সময় কংক্রিটের স্ল্যাব পড়ে থেঁতলে গিয়েছিল তার ডান হাত। টানা দু’মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিল গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এখন মরণব্যাধি ক্যান্সার গ্রাস করেছে আন্নাকে। ডান পায়ে সৃষ্টি হওয়া ব্যথা এখন রূপ নিয়েছে ক্যান্সারে। এখন তার পা কেটে ফেলতে হবে- তা না হলে বাঁচানো যাবে না আন্নাকে। বেঁচে থাকার জন্য আবার জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে। আন্না বলে, ‘সেদিনই ভাবছিলাম মইরা যামু। আল্লাহ আমারে নতুন জীবন ফিরাইয়া দিছিল। কিন্তু ভাগ্য মনে হয় আমার সঙ্গে নাই। হাত হারাইয়া এখন আবার পা-ও হারাতে হবে। আল্লাহ কেন আমাকে এমন শাস্তি দিচ্ছে। এমনই যদি হওয়ার কথা ছিল তাহলে তখনই আর বাঁচাইয়া রাখলো কেন?’ রাজধানীর মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে এমনিভাবে আর্তনাদ করছে কিশোরী আন্না খাতুন। চিকিৎসকরা বলেছেন, তাকে সুস্থ করে তুলতে হলে কেটে ফেলতে হবে তার বাম পা। আন্না বলে, রানা প্লাজায় ছয় তলায় কাজ করতো সে। গত বছর ৭ই এপ্রিল কাজে যোগ দিয়েছিল। বাবা-মায়ের পক্ষে একা সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না দেখে নিজের ইচ্ছাতেই হেলপার হিসেবে ইথারটেক্স নামের গার্মেন্টে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু ১৭ দিনের মাথায় ধসে পড়ে সে রানা প্লাজা। আন্না বলে, বাঁচার জন্য শত চেষ্টা করেও বের হয়ে আসতে পারিনি সেদিন। এক ধাক্কায় যেন আমাকে নিয়ে গিয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। তখন কংক্রিটের স্লাব পরে আমার ডান হাত থেঁতলে যায়। দু’দিন ধরে এই থেঁতলে যাওয়া হাত নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে পড়ে থাকি। বুঝতে পারিনি সেখানে গিয়ে আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে। শুধু আল্লাহর নাম নিয়েই এদিনটি পার করেছি। সেই সময় আল্লাহর দূত হয়েই স্বেচ্ছাসেবক কর্মীরা আমাকে উদ্ধার করতে যায় সেখানে। সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করে হাত না কেটে আমাকে বাঁচাতে। কিন্তু সেদিন যদি আমাকে হাত কেটে বের করে না আনতো তাহলে আজ আর আমি থাকতাম না। আন্নার মা খজিরন বেগম বলেন, সেদিন হাত কাটা অবস্থায় ফিরে পেয়েছিলাম আমার মেয়েকে। মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম তার মুখখানা দেখে। ভেবেছিলাম মেয়ে তো তার জীবন ফিরে পেয়েছে। এখন যদি আবার তার পা-ও হারাতে হয় তাহলে কিভাবে চলবে তার জীবন। আমার মেয়ের তো কোন ভবিষ্যৎ থাকবে না। কোন কিছু করতে পারবে না। রানাপ্লাজা ধসের দু’দিন পর মেয়েকে ফিরে পেয়েছিলাম এনাম মেডিকেলে। সেখানে প্রায় ২ মাস ১০ দিন চিকিৎসার পর সুস্থ করে তোলা হয়েছিল তাকে। এক হাত হারিয়ে তার মনে অনেক কষ্ট ছিল। কিভাবে এখন নিজের কাজ নিজে করবে। আমরা সবাই মিলে সান্ত্বনা দিয়ে তাকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করি। এই দুর্ঘটনার পরে সাভার থাকার আর কোন ইচ্ছা ছিলো না আমাদের। এখানে এসে আমার মেয়ের হাত হারাতে হয়েছে- তাই সপরিবারে চলে যাই জামালপুরের নারিকেলিয়া কুমারপাড়ায়। সেখানে গিয়ে সবকিছু ভালই চলতে থাকে। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর একদিন হঠাৎ করে পা পিছলে পড়ে যায় আন্না। এতে ডান পায়ে সে ব্যথা পায়। তখন ব্যথার ওষুধ খেয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায় সবকিছু। দেড় মাস আগে থেকে আস্তে আস্তে সেই ব্যথা বাড়তে শুরু করে। এক সময় তা সহ্য সীমার বাইরে চলে যায়। তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জামালপুরের সদর হাসপাতালে। সেখানে ডা. মাহবুবুল তাকে দেখে ১ মাসের ওষুধ দিয়ে দেন। কিন্তু এতেও ব্যথা সারেনি। তখন ডা. মাহবুবুল বলেন, আমরা আর কিছু করতে পারবো না, আপনারা ঢাকায় নিয়ে যান। এরপর তাকে নিয়ে আসা হয় সাভারের এনাম মেডিকেলে। সেখানে পরিচালক রওশন আরা তার চিকিৎসার সব কিছু দেখাশোনা করেন। ব্যথার জন্য স্বাভাবিক চিকিৎসা দেয়ার পর যখন ব্যথা সারেনি তখন তার হাঁটুর উপরের অংশ থেকে মাংস কেটে তা পরীক্ষা করা হয়। সে পরীক্ষায় ধরা পড়ে আন্নার পায়ের সেই অংশে ক্যান্সার।
রওশন আরা বলেন, পরীক্ষার এই ফলাফল পাওয়ার পর আমি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বিজিএমইএকে জানিয়েছি। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে রেফার করেছি।
মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালের শিশু ক্যান্সার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাশেদ জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, আন্নাকে এখানে পাঠানোর পর তার রিপোর্টগুলো আমরা দেখেছি। রিপোর্টে  রেবডোমায়োসারকোমা নামের একটি ভাইরাস ধরা পড়েছে। তবে আমরা বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য এখানে আবার পরীক্ষা করবো। এই পরীক্ষার ২১ দিন পর তার চিকিৎসা শুরু করা হবে। তিনি আরও বলেন, পরীক্ষায় যদি এই ভাইরাসই ধরা পড়ে তাহলে আন্নার পা কেটে ফেলা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। কারণ এটি হাড়েও ছড়িয়ে পড়েছে। এখন তার পা কাটা না হলে এটি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।

No comments

Powered by Blogger.