৩ লাখ কোটি টাকা পাচার by মামুন আব্দুল্লাহ

স্বাধীনতার পর গত চার দশকে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রতি বছর গড়ে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে ৮০ কোটি ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকার মতো। মাথাপিছু পাচার হয়েছে গড়ে ২০৫ ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা হিসাবে)।

উন্নয়নশীল ৮টি দেশ থেকে টাকা পাচারবিষয়ক জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ১৯৭০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে তারা এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে টাকা পাচার হওয়ার কারণে দেশগুলোর আর্থিক অবস্থা, জনজীবনে এর প্রভাব, বাজেট ঘটতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পণ্যের আমদানি রফতানি, রেমিটেন্স ও হুণ্ডির মাধ্যমে এসব টাকা পাচার করা হয়েছে। আটটি দেশের মধ্যে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রথম স্থান দখল করেছে আইভরি কোস্ট, পঞ্চম স্থানে নেপাল।
এদিকে গত বছরের শেষ দিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে ২৮০ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা ২২ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। ২০১০ সালে পাচার করা হয়েছিল ২১৯ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ১৭ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। ওই এক বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়েছে ২৮ শতাংশ।
এদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদেশ থেকে যে পরিমাণ রেমিটেন্স আসে তার প্রায় ৪০ শতাংশই হুণ্ডির মাধ্যমে। ফলে ওই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশ থেকে বর্তমানে মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানির নামে ব্যাপকভাবে টাকা পাচার হয়েছে। গত বছর দেশে বিনিয়োগ হয়নি। শিল্প উৎপাদন বাড়েনি, তারপরও শিল্পের যন্ত্রপাতি বেড়েছে। এই বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। টাকা পাচার রোধ করা না গেলে দেশের উন্নয়ন হবে না। বরং সমাজে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে যা দেশকে বড় ধরনের সংকটের দিকে নিয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা আগে থেকেই বলে আসছি মুদ্রা পাচার হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করা উচিত। এটা সরকার না করলে আর দেশে পুঁজি রাখা যাবে না।
ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থ পাচারের ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ফলে দেশের বাজেটে বৈদেশিক ঘাটতির সৃষ্টি হচ্ছে। এই ঘাটতি মেটাতে সরকারকে বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই প্রবণতার ফলে তুলনামূলকভাব সরকার দরিদ্র হয়ে যায়। সরকারের চেয়ে ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যায়। যা সমাজে বড় ধরনের ভারসাম্যহীতার সৃষ্টি করে। অর্থ পাচারের ফলে দারিদ্র্য বিমোচন বা জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমে সরকারের অবদান কমে যায়। জনগণ দরিদ্রতায় ভোগে। দেশী বিনিয়োগ কমে যায়। কর্মসংস্থানেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পাচার হওয়ার কারণে দেশী বিনিয়োগ কমে যায়। একই সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যায়। যা দেশের সুশাসন ব্যবস্থাকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলে দেয়। ভেঙে পড়ে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো। এর প্রভাবে একদিকে সমাজে যেমন আইনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায়। তেমনি অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্পদ পাচারের ফলে দেশের অর্থনীতি হয়ে যাচ্ছে রক্তশূন্য।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, টাকা পাচারের ফলে সৎভাবে জীবনযাপন যারা করতে চান তারা বেশি করে চাপের মুখে পড়েন। কেননা তারা সম্পদ গোপন করতে চান না। ফলে তাদেরকে বেশি করে কর দিতে হয়। আর যারা টাকা পাচার করেন বা সম্পদ গোপন করে কালো টাকার সৃষ্টি করেন তাদেরকে কর কম দিতে হয়। ফলে সমাজে সুষম কর কাঠামোও গড়ে ওঠে না। এছাড়া পাচার করা অর্থ সাম্প্রতিককালে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করার নজিরও পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অর্থ পাচারের নেপথ্যে রয়েছে মূলত দুর্নীতি, অনিয়ম ও আইন প্রয়োগে শিথিলতা। ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা এসব খাতে প্রভাব খাটিয়ে টাকা পাচার করেন।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান যুগান্তরকে বলেন, টাকা পাচার হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে, এই টাকা অর্জনও হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমেই। তাই সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতি বন্ধ না হলে টাকা পাচার বন্ধ হবে না। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিকভাবে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার লাগবে। যেটা বর্তমানে বাংলাদেশে নেই।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা তথ্য মতে, এসব দেশের ক্ষমতাবান রাজনৈতিক বিত্তবানরা তাদের ক্ষমতাকে আরও পোক্ত করতে অর্থ পাচারের মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করে থাকেন। এদের কারণে সরকারকে জনগণের ওপর কর বাড়াতে হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের অন্যতম পথ হচ্ছে, আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য কম বা বেশি দেখানো। এর ফলে দেশ থেকে পাচারের হার হচ্ছে ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ। বাকি ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ পাচার করা হয় হুণ্ডির মাধ্যমে। বিভিন্ন দেশের এজেন্টের মাধ্যমে এই হুণ্ডি ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে।
আর্থিকভাবে অনগ্রসর ও স্বল্প আয়ের (এলডিসি) ৮ দেশের অবৈধ আর্থিক প্রবাহ নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। বিগত ৪ দশকের (১৯৭০-২০১০) তথ্য এখানে দেয়া হয়েছে। দেশগুলো হল- বাংলাদেশ, বলিভিয়া, আইভরি কোস্ট, গিনি, নেপাল, সিয়েরালিয়ন, তানজানিয়া ও জিম্বাবুয়ে।
প্রতিবেদনের প্রথমেই বলা হয়েছে, বিগত দশকগুলোতে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতিতে অবিশ্বাস্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এর মধ্যে ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল এসব দেশের গড় জিডিপির হার ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ। পরের দশকে যা ডাবল ডিজিটে দাঁড়িয়েছে। ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এসব দেশে গড় জিডিপির হার ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। যা বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও অনুন্নত এসব রাষ্ট্র সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনের পথে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে অবৈধ আর্থিক প্রবাহ ও মুদ্রা পাচার টেকসই উন্নয়নকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করছে। মুদ্রা পাচার নিয়ন্ত্রন করা গেলে দেশগুলোর দ্রুত উন্নয়ন হতো। দেশগুলোতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই মূলত মুদ্রা পাচার হচ্ছে।
ইউএনডিপির তথ্য মতে, সিয়েরালিয়নের ক্ষেত্রে তা দাঁড়িয়েছে জিডিপির অনুপাতে ৫২৩ দশমিক ৬ শতাংশে। বলা যায়, মুদ্রা পাচার সিয়েরালিয়ন জনসংখ্যার ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই দেশের মোট জনসংখ্যার হিসাবে মাথাপিছু মুদ্রা পাচারের পরিমাণ ২ হাজার ৮৩৮ ডলার। ২০১০ সালের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ১ হাজার ১৬১ ডলার। সম্প্রতি সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা রয়েছে বলে তথ্য বেরিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.