জামায়াতের বিচার না করা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত by উৎপল রায়

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনে সংশোধনী ছাড়া জামায়াতের বিচারের বিরোধিতা করে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হকের দেয়া বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, জামায়াতের বিচার না করা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এটি রাজনৈতিক কৌশলের একটি অংশ। আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন প্রসঙ্গে তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে প্রভাবিত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বর্তমান আইনে জামায়াতের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এ নিয়ে তোলপাড় চলার মধ্যেই শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যই সমর্থন করেন। এ ব্যাপারে  শিক্ষাবিদ ও ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, আমরা বরাবরই জামায়াতকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মত দিয়েছি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে যা-ই থাক না কেন তাদের নিষিদ্ধ করার জন্য বিদ্যমান সন্ত্রাসবিরোধী আইনই যথেষ্ট বলে মনে করি। তিনি বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধকরণ প্রশ্নে সরকারের কে কি বললো সে বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই। সরকারের যদি আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকে তাহলে ট্রাইব্যুনাল আইনে যা-ই থাকুক না কেন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তাদের নিষিদ্ধ করা যায়।

এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্র্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতের বিচার নিয়ে যা চলছে এটির মূল কারণ হতে পারে রাজনৈতিক। গত ২২ বছর ধরে আমরা বলে আসছি এ বিষয়টিকে যাতে রাজনীতিকরণ করা না হয়। আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, তার বক্তব্য বিভ্রান্তিকর এবং তা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে বোঝা যায় আইনটি তিনি ভালভাবে পড়ে দেখেননি। ওনার মাথায় এখনও ফৌজদারি মামলার আইন ঘুরছে। জামায়াতের বিচার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে শাহরিয়ার কবির বলেন, প্রধানমন্ত্রী আইন বিশেষজ্ঞ নন। তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আইনমন্ত্রী যেভাবে তাকে বুঝিয়েছেন তিনি সেভাবেই বলেছেন। অথবা অন্য কেউ তাকে এভাবে বুঝিয়েছে। এটা যদি সরকারের সিদ্ধান্ত হয় তবে তা হবে খুবই দুঃখজনক। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার সম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, সব আইনে শাস্তির বিধান থাকে না। এই আইনের ২০ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সংগঠনের বিচার করা যাবে। এখন আইনমন্ত্রী হয় জেনে না হয় না জেনে এসব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। শাহরিয়ার কবির বলেন, আইনমন্ত্রী অনেক কারণ দেখিয়েছেন। এখন আমি বলতে চাই নিজামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ চলাকালে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় ঘোষণা করা হয়নি? তিনি বলেন, সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের শাস্তি কাকে দেয়া হবে এটা তিনি কি করে বলেন? বিষয়টি নির্ধারণ করবেন তো ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা। তিনি বলেন, যদি জামায়াতের বিচার সম্ভব না হতো তাহলে সরকারের আগের আইনমন্ত্রী (ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ)  কিভাবে বলেছিলেন বিচার সম্ভব? তাছাড়া, যে সব আইন বিশেষজ্ঞ জামায়াতের বিচার করা যাবে মর্মে বিবৃতি দিচ্ছেন তারা কি না জেনেবুঝে এসব বলছেন?
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন জামায়াতের বিচারে আইনের বাধাকে একটি অজুহাত উল্লেখ করে বলেন, এটি বর্তমান সরকারের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যার সঙ্গে আইনের ব্যাখ্যার কোন সম্পর্ক নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বিচার হবে। তিনি এটি বলেননি যে বিচার হবে না। কিন্তু কবে হবে  সেটি বলেননি। এত দূর এসে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এভাবে কথা বলায় আমরা যারপরনাই হতাশ হয়েছি। তিনি বলেন, সরকারের ব্যাখ্যার প্রসঙ্গে বলতে চাই, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই আইনে এত বড় একটা অসঙ্গতি যদি ছিলই তবে তা আগে ধরা পড়লো না কেন? এখন শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে জামায়াতের বিচার প্রলম্বিত হবে বলে মনে করি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে একটি ভুল তথ্য বের করানো হয়েছে। তার মুখ থেকে যখন এ ধরনের কথা শোনা হয়, তখন তা হতাশার। কারণ দীর্ঘ দিন পরে হলেও অসীম সাহসিকতার সঙ্গে তিনিই জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াটি শুরু করেছিলেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রীকে এই আইনের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ভুল বোঝানো হয়েছে অথবা এ বিষয়ে তাকে প্রভাবিত করা হয়েছে। তবে কারা এসব করছে তা জানি না। এটি হতে পারে রাজনৈতিক। কারণ সরকারের মধ্যেও সরকার থাকে। তিনি বলেন, প্রচলিত আইনেই জামায়াতের বিচার সম্ভব। আইনের ২০ (২) ধারায় এ বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। যেহেতু আইনে সংগঠনের বিচারের বিষয় উল্লেখ করা আছে, সেহেতু বিচার করতে বাধা কোথায়? বাচ্চু বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এ আজীবন  কারাবাস ও ৯০ বছরের কারাদ-ের উল্লেখ নেই। তবুও তো ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা দোষীদের এ শাস্তি দিয়েছেন। বেশ ক’টি রায়ে জামায়াতকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাহলে সেই আলোকে জামায়াতের বিচার করতে দোষ কোথায়? বিষয়টি কেবল জুরিসডিকশন ও জাজমেন্টের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি তা-ও সম্ভব না হয় তাহলে প্রয়োজনে আবারও আইনটি সংশোধন করে জামায়াতের বিচার করা হোক।

No comments

Powered by Blogger.