এশিয়া যে পথে হাঁটছে by সাজ্জাদ শরিফ

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডকে দেখাল আকর্ষক এক মডেলের মতো৷ কে বলবে তাঁর এখন ৫২ চলছে? নিখুঁত আর পরিপাটি ঘন নীল রঙের জামা তাঁর দীর্ঘ ছিপছিপে শরীরটিকে ফ্রেমবদ্ধ করে রেখেছে৷ মাথা থেকে ঘাড়ের কাছে এসে থেমে গেছে লালচে সুবিন্যস্ত চুল৷ মঞ্চে উঠলেন মডেলের মতো, সটান দাঁড়িয়ে এশিয়া নিয়ে তাঁর ভাবনা প্রকাশ করলেন ধারালো কণ্ঠে৷
‘নতুন এশিয়ার রূপায়ণ’-এর কার্যকর উপায় খুঁজতে দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে ভাবনা-বিনিময়ের আসর বসেছে৷ এই আসরে উদ্বোধনের পরের দুই দিনে অধিবেশন বসল মোট ৬০টি৷ রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি বিশ্ববাণিজ্যের হর্তাকর্তা, দিকপাল বিশেষজ্ঞ আর বাণিজ্য-সহযোগীরা সেখানে এশিয়ার বিকাশ আরও দ্রুত, ফলপ্রসূ ও সুস্থায়ী করার নতুন নতুন উপায়ের কথা বললেন৷
কেন্দ্রীয় অধিবেশনে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল জুলিয়া গিলার্ড আর চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লি ঝাওজিংকে৷ তবে তাঁদের আগে শুভেচ্ছাবার্তা জানাতে উঠলেন ফিলিস্তিনের সাবেক ও স্বল্পকালীন প্রধানমন্ত্রী সালাম ফাইয়াদ৷ বললেন, পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিচিত্র উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু মুক্তি, ইনসাফ আর সাম্য—মানুষের এই তিন চাহিদা মেটাতে না পারলে কোনো উদ্যোগই স্থায়ী শান্তি আনতে পারবে না৷ মানুষ যে নতুন বিশ্বব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে, তাও তো দুই দশকেরও বেশি হয়ে গেল৷ তাদের জীবনে শান্তি আর সমৃদ্ধির বার্তা কোথায়৷ বললেন, ‘আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ, তা না হলে গোটা বিশ্বব্যবস্থাই একসময় ভেঙে পড়বে৷

জুলিয়া গিলার্ড বললেন, পৃথিবীতে এখন এসেছে পরস্পর-নির্ভর বিকাশের যুগ৷ এশিয়ায় এক চীনই তার অর্থনৈতিক উত্থানের মধ্য দিয়ে আশপাশের দেশের আর্থিক গতিশীলতার ধরন পাল্টে দিয়েছে, ভেঙে দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের ভবিষ্যৎ ভাবনার ছক৷ এ শতকের প্রথম ভাগের মধ্যে চীন পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে৷ চীনের অর্থনৈতিক বিকাশ যেমন অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিকে চাঙা করে তুলেছে, তেমনি তা নতুন কিছু ঝুঁকিও সৃষ্টি করেছে৷ জুলিয়া বললেন, আরব বসন্ত দেখিয়ে দিয়েছে, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি যে শূন্যতা তৈরি করে, তার পথ দিয়ে ভালো কিছু আসা কঠিন হয়ে পড়ে৷ অর্থনীতিতে চীন যা ঘটিয়েছে, তা অলৌকিক৷ কিন্তু সেখানে গণতন্ত্র না এলে এবং মানবাধিকারের ভিত্তি না গড়তে পারলে এ অর্থনীতি এশিয়া ও বিশ্বের জন্য আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে৷ উত্তর কোরিয়া যে নতুন পারমাণবিক হুমকি হয়ে উঠেছে, তার পেছনের শক্তি তো চীনই বটে৷ এ ব্যাপারে জুলিয়ার নিদান হলো, বিশ্বসম্প্রদায়ের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে, আর তাতে মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে৷
জুলিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী হলো, ভবিষ্যৎ পৃথিবী কোন চেহারা নেবে, সেটি নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের ওপর৷ সম্পর্কটি আর আগের মতো সরল হবে না, হবে জটিল ও বহুস্তরীয়৷ বিশ্বসম্প্রদায়ের কর্তব্য হবে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করা৷
চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লি ঝাওজিং মঞ্চে উঠে প্রথমেই এশিয়া সম্পর্কে সবার পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর অনুরোধ করলেন৷ বললেন, বিশ্ব-অর্থনীতিতে এশিয়ার একার অবদানই এখন এক-তৃতীয়াংশ৷ এশিয়া একটি স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত মহাদেশ৷ বাইরে থেকে কেউ এসে এতে আঘাত করা অন্যায় হবে৷ স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছে বলা হলেও তার রেশ রয়ে গেছে৷ তিনি বেশ শক্তভাবে বললেন, এশীয় দেশগুলোর সংগত পদক্ষেপে বহিরাগত কেউ যেন বাধা না দেয়৷
লি ঝাওজিং এর পরে যোগ করলেন, তার পরও সব রাষ্ট্রের একটি সাধারণ স্বার্থের জায়গা আছে৷ নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও তাই সংলাপভিত্তিক এই আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রসার ঘটছে৷ এশিয়ার বর্তমান সাফল্যগাথার পেছনেও আছে এই সংলাপ৷ জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে সর্বোচ্চ প্রাপ্তির জন্য নানাপক্ষীয় সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে৷
জেজু ফোরামের সেমিনারে, একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে জুলিয়া গিলার্ড ও লি ঝাওজিং নিজেদের স্বতন্ত্র মতামত যেমন বেশ স্পষ্ট করেই জানালেন, আবার সব বিরোধ সত্ত্বেও সহযোগিতা ও সংলাপের ওপরও জোর দিলেন একটু তীব্রভাবে৷

সোউল, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে
সাজ্জাদ শরিফ: কবি, সাংবাদিক৷

No comments

Powered by Blogger.