আশ্চর্য দ্বীপ জেজু

জেজু দ্বীপ: গাছগাছালির ফাঁকে
ফাঁকে ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্য
জেজু দ্বীপ যেন অপেক্ষা করছিল আমাদের চমকে দেওয়ারই জন্য৷ উড়োজাহাজের আবদ্ধ পেট থেকে নেমে তার আকস্মিক সৌন্দর্যের ঝাপটায় ভাষা হারিয়ে গেল৷ এ দ্বীপের জন্ম ২০ লাখ বছর আগে, আগ্নেয়গিরির লাভা জমে জমে৷ মৃত সেই আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ এখন চেনা যায় না৷ ঘন সবুজ গাছের কোমলতায় সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত৷ জেজু দ্বীপের চারপাশে যে জলরাশি, তা কেবল নামেই দক্ষিণ সাগর৷ দ্বীপটি আসলে প্রশান্ত মহাসাগর ভেদ করেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷ গাঢ় সবুজ দ্বীপ৷ গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্য৷ এই সমতল, তো এই পাহাড়ি খাড়াই-উতরাই৷
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক বিস্ফোরণের প্রাচুর্য এই দ্বীপটির আদিম নিসর্গ অনেকটা নমনীয় করে এনেছে৷ কিন্তু কেবল নিসর্গের মাত্রাতেই তো নয়, দ্বীপটি চমকপ্রদ হয়ে উঠেছে এর প্রশাসনিক অনন্যতার কারণেও৷ জেজু আগে ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার নয় প্রদেশের একটি৷ গণভোটে রায় দিয়ে এ দ্বীপের বাসিন্দারা একে একটি বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়৷ ২০০৬ সালের ১ জুলাই থেকে এটি কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি শাসন থেকে নিজেদের মুক্ত করে৷ জেজু একদিন ধীরে ধীরে একটি ‘মুক্ত আন্তর্জাতিক নগর’ হয়ে উঠবে, সেটিই এই দ্বীপবাসীর স্বপ্ন৷ কোরিয়া ফাউন্ডেশনের সহযাত্রী জানালেন, কোনো ভিসা ছাড়াই এখানে এসে দিব্যি একটি মাস সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়৷ নতুন এই ব্যবস্থাপনার পর জেজুর মতো চোখধাঁধানো দ্বীপে পর্যটকের স্রোত যে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে, তা আর আশ্চর্যের কী! আমরা ১৮টি দেশের ২৩ জন সংবাদকর্মী এই দ্বীপে এসেছি, কোরিয়া ফাউন্ডেশনের তদারকিতে৷ নিছকই বেড়াতে নিয়ে আসা নয়, আমাদের ২৮ মে নবম জেজু ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আঁচ অনুভব করানো তাদের আসল উদ্দেশ্য৷ এ ফোরামের অন্যতম উদ্যোক্তা জেজুর বিশেষ আত্মনির্ভর সরকার৷ এশিয়াতে শান্তি ও সমৃদ্ধির বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করা এ ফোরামের মূল উদ্দেশ্য৷ এবারে তিন দিন ধরে যেসব আলোচনা হলো, তার কেন্দ্রীয় ভাবনা ‘নতুন এশিয়ার রূপায়ণ’৷ ভাবনা এশিয়াকে নিয়ে, কিন্তু আয়োজকেরা যুক্ত করছেন এর বাইরের মানুষদেরও৷ এই ফোরামকে তাঁরা বহুপক্ষীয় মতামত ও সহযোগিতার একটি কেন্দ্রভূমি হিসেবে গড়ে তুলতে চান৷ আলোচনায় অংশ নিতে তাই এসেছেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড, চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লি ঝাওজিং ও ফিলিস্তিনে স্বল্পকালের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া সালাম ফাইয়াদ৷
আরও এসেছেন বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা৷ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন উপলক্ষে অতিথিদের নৈশভোজে আপ্যায়ন করল কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ বিপুল লোকের এক এলাহি আপ্যায়নপর্ব৷ নৈশভোজ-পূর্ব বক্তব্য রাখলেন এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইয়ুন বিউং-সে৷ বুঝতে অসুবিধা হয় না, এশিয়া বলতে তাঁরা পূর্ব এশিয়াই বোঝান৷ মন্ত্রীর বক্তব্য ছোট, কিন্তু সুচিন্তিত৷ তাতে আকাঙ্ক্ষার ইশারাটি সুস্পষ্ট৷ বললেন, প্রতিটি দেশের বাণিজ্যের প্রসার এখন বিভিন্ন দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল৷ সহযোগিতার হাত যাঁরা গুটিয়ে রাখবেন, তাঁরা শুধু অন্যের নন, নিজেদেরও বিরাট ক্ষতি করবেন৷ নানা দেশের সম্পর্ক তাই নতুন নতুন মাত্রায় জোরালো করতে হবে৷ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য এ যুগে বিশ্বসমাজেরও ঐক্য প্রয়োজন৷ জল-স্থল-আকাশের যোগাযোগব্যবস্থার নিরাপত্তা এবং সাইবার-নিরাপত্তার জন্য সব দেশের একসঙ্গে কাজ করার ওপর তিনি অসম্ভব জোর দিলেন৷ বাণিজ্যের যে বিপুল সম্প্রসার ভবিষ্যতে অপেক্ষা করছে, সাইবার-নিরাপত্তার জন্য বিশ্ব সম্মিলিতভাবে কাজ না করলে তিনি তার বড় অংশই হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা জানালেন৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, এ তো সত্য কথা যে ইতিহাসের অমীমাংসিত প্রসঙ্গ, জাতিবাদের উত্থান, জাতীয় স্বার্থের টানাপোড়েন—এসব কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে রেষারেষি হবে৷ আঞ্চলিক আবহাওয়া তাতে তপ্ত হয়ে পড়বে৷ কোরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের সমবায়ে সংকট মোকাবিলার জন্য ছোট্ট কিন্তু কার্যকর একটি ফোরাম এখন আমাদের দ্রুত গঠন করা দরকার৷’ কোরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণের পরে হাততালির যে স্রোত বয়ে গেল, সহজে কি আর তা থামে! বোঝা গেল, এ হাততালি কেবল সৌজন্যের নয়, অনেকের অন্তরেরও৷
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে
সাজ্জাদ শরিফ: কবি, সাংবাদিক৷

No comments

Powered by Blogger.