নারায়ণগঞ্জ কী অশনিসংকেত দিচ্ছে by মহিউদ্দিন আহমদ

দেশে খুনখারাবি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। সাধারণ মানুষের মনের ভেতরে বাসা বেঁধেছে ভয় আর অনিশ্চয়তা৷ সবাই বলেন আইনের শাসনের কথা। আইনের শাসন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী কিছুদিন আগে এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এদের কাজ হলো এখন ‘দুষ্টের পালন ও শিষ্টের দমন’৷ মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসছে না। যারা আসছে, তারাও লাশ হয়ে ফিরছে।

কেন এমন হচ্ছে? এ নিয়ে নানান জনে নানান কথা বলছেন। কেউ বলছেন সামাজিক অবক্ষয়, কেউ বলছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার পঁায়তারা, কেউ বা বলছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথে বাধা তৈরির ষড়যন্ত্র। বাইরের শক্তির ইন্ধনের ইঙ্গিতও দিচ্ছেন কেউ কেউ। প্রধান দুই রাজনৈতিক পক্ষ অবশ্য আততায়ী ও অপরাধীদের ইতিমধ্যে শনাক্ত করে ফেলেছে। এক পক্ষ বলছে, সব দোষ শেখ হাসিনার, তিনিই এসব করাচ্ছেন। অন্য পক্ষ বলছে, এসবই খালেদার কাজ। তাদের এই নির্লজ্জ দলবাজি দেখতে দেখতে সাধারণ নাগরিকেরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তারা কোথায় যাবে?
প্রধানমন্ত্রী বলে আসছেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে জেনারেল জিয়াউর রহমান গুম ও খুনের রাজনীতি চালু করেছেন। কথাটা মোটেও সত্য নয়। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক মানুষ নিরুদ্দেশ কিংবা নিহত হয়েছিলেন। অবস্থা এমন চরমে পৌঁছেছিল যে সরকারি পত্রিকা দৈনিক বাংলায় নির্মল সেন একটা উপসম্পাদকীয় লিখে সবার নজর কেড়েছিলেন। এর শিরোনাম ছিল, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। এটা ১৯৭৪ সালের ঘটনা। বিএনপি নেতারা প্রায়ই এই শিরোনামটি উল্লেখ করে জনসভা কিংবা সেমিনারে তর্জনী উঁচিয়ে কথা বলেন। তবে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি তঁারাও দিতে পারেননি। একটি উদাহরণই যথেষ্ট, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং পরবর্তীকালে ‘জজ মিয়া’ চিত্রনাট্যের প্রযোজনা। তাই তঁাদের কথাও সাধারণ নাগরিকেরা খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নেন না।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে। আমরা জানি, রাষ্ট্রে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সজ্ঞানে সমর্থন দেয়। সে জন্যই বাহিনীগুলোকে আইন করে সুরক্ষা দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে আইন করে সুরক্ষা দিয়েছিল। এই বাহিনীর হাতে যে কত মানুষ মারা গেছে, আমাদের কাছে তার হিসাব নেই। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীদের সুরক্ষা দিতে ‘ইনডেমনিটি’ আইন করা হয়েছিল। বিএনপি সরকার ‘অপারেশন িক্লন হার্ট’ চালানোর সময় অনেকেই লাশ হয়ে পথে-ঘাটে পড়ে থাকতেন। তখনো বাহিনীগুলো আইনের সুরক্ষা পেয়েছিল। র৵াব তাদের হাতেই তৈরি। এটা এখনো তার ম্যান্ডেট অনুযায়ী কাজ করে
যাচ্ছে। সঙ্গে আছে আইনের সুরক্ষা। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ও জবাবদিহির অনুপস্থিতিতে তঁাদের অনেকেই গ্রেপ্তার, অপহরণ ও খুন-বাণিজ্যে
জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠছে। আমরা অনেকেই ফ্রাংকেনস্টাইনের কথা জানি। একবার দৈত্য ছেড়ে দিলে তাকে আর বোতলের মধ্যে ঢোকানো যায় না।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সাত খুনের ঘটনা সবাইকে নাড়া দিয়েছে। এই নৃশংসতার নিন্দা করার ভাষা নেই। এ নিয়েও চলছে দলবাজি ও চালাকি। ক্ষমতাসীনেরা মানুষকে কি নির্বোধ ভাবেন?
সাত খুন অবশ্য ঘটল দ্বিতীয়বার। প্রথমবার ঘটেছিল চুয়াত্তরের ২ ও ৩ এপ্রিলের মধ্যবর্তী রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সূর্য সেন হল থেকে সাতজন ছাত্রকে ধরে এনে মুহসীন হলের টেলিভিশন কক্ষের সামনে দঁাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সকালে আমি ওই জায়গায় কয়েক ইঞ্চি পুরু জমাট বঁাধা রক্ত দেখেছিলাম। ওই দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে মিছিল হয়েছিল। মিছিলে স্লোগান ছিল ‘হত্যাকারীদের ফঁাসি চাই’। কয়েক দিনের মধ্যেই এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে শফিউল আলম প্রধানসহ ১৫ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এই হত্যাকাণ্ড ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের এক অংশের মধ্যে নোংরা দলাদলির প্রতিফলন, যার পেছনে কোনো আদর্শের ছিটেফেঁাটাও ছিল না। ছাত্রলীগের ওপর কর্তৃত্ব রাখাটাই ছিল মুখ্য। বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। কয়েক বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮২ জন শিক্ষক শফিউল আলম প্রধানের মুক্তি দাবি করে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। তঁারা ভুলে গিয়েছিলেন, নিহত ব্যক্তিরাও তঁাদের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমষ্টিগত নৈতিক স্খলন সম্ভবত তখন থেকেই শুরু। শাস্তির পুরো মেয়াদ না খেটেই তঁারা মুক্ত হন। প্রধান এখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৯-দলীয় জোটের শরিক এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ‘অতন্দ্র প্রহরী’।
১৯৮২ সালে বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এর পটভূমি আমরা জানি। ওই সময় দেশের আইনশৃঙ্খলব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবন থেকে কুখ্যাত সন্ত্রাসী ইমদুকে গ্রেপ্তার করা হলে সাত্তার সরকারের বিদায়ঘণ্টা বেজে যায়। এরশাদ এই ঘটনাগুলোকে পুঁজি করতে পেরেছিলেন। এটাও সত্য যে সাধারণ মানুষ হঁাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। এক-এগারো যখন ঘটল, সাধারণ মানুষ তখনো খুশি হয়েছিল। যারা এটা বিশ্বাস করেন না, তঁারা গণভোট নিয়ে এটা যাচাই করে দেখতে পারেন।
‘অগণতান্ত্রিক শক্তি’ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার জন্য ওত পেতে আছে বলেও নেতা–নেত্রীরা দাবি করেন৷ তবে জনসমর্থন ছাড়া কোনো শক্তি কখনোই ক্ষমতা দখল করতে পারেনি, দখল করলেও টিকে থাকতে পারেনি৷ এটা আমরা দেখেছি ১৯৫৮ সালে, ১৯৮২ সালে এবং সর্বশেষ ২০০৭ সালে। আর এটা সমাধান নয়, প্রতিবারেই তা প্রমাণিত হয়েছে। তবে এটাও তো সত্য, আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অতীত থেকে কোনো শিক্ষাই নেয়নি। এবারে নেবে কি?

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক৷
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.