আমি কি একজন বিশ্বাসঘাতক?

গুলিবিদ্ধ হামিদ মিরের ছবি মোবাইল
থেকে দেখাচ্ছেন এক সমর্থক
বিশ্বাসঘাতক দু্ই ধরনের হয়৷ প্রথম ধরনের বিশ্বাসঘাতকেরা বিদেিশ শক্তির সঙ্গে যোগসাজশে স্বজাতির মানুষদের দাসে পরিণত করে৷ এই ধরনের ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম মির জাফর আলী খান, যিনি ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনীর প্রধান৷ এখন তঁার নাম বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক শব্দ হিসেবে উচ্চারিত হয়৷ তঁার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনী ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়৷ ফলে, ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের পদানত হয়৷ আরেক ধরনের ‘বিশ্বাসঘাতক’ বিদেিশ শক্তির সঙ্গে হাত মেলায় না; বরং তারা স্থানীয় শক্তিশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দঁাড়িয়ে বিদেিশদের সঙ্গে তাদের অঁাতাতের বিরোধিতা করে৷ এই স্থানীয় গোষ্ঠী ‘দেশপ্রেমের’ নামে বিদেশিদের সঙ্গে অঁাতাত করে থাকে৷ এই দ্বিতীয় ধরনের বিশ্বাসঘাতকদের হাতে অস্ত্র ও ট্যাংক থাকে না, থাকে না যুদ্ধবিমানও৷ তঁাদের অস্ত্র হচ্ছে জিব, যা দিয়ে তঁারা সত্য কথা বলেন৷ আর থাকে কলম, যেটা দিয়ে তঁারা সত্য কথা লেখেন৷ তঁারা যখন সত্য কথা বলেন বা লেখেন, তখন বন্দুকধারীরা গড়বড় হয়ে যান আর এই সত্যবাদীদের বিশ্বাসঘাতক বলেন৷ আমাদের সমকালীন ইতিহাসে এই দ্বিতীয় ধরনের বিশ্বাসঘাতকদের আধিক্য দেখা যাচ্ছে৷ বর্তমানে আমার মতো মানুষ এবং এই দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত বিশ্বাসঘাতকদের গায়ে মার্কা মারার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ যঁারা বন্দুকের বলে বলীয়ান, তঁারা আমাকে ও আমার প্রতিষ্ঠান জিয়ো টিভির গায়ে মোড়ক লাগানোর চেষ্টা করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, তঁারা আমার নাগরিকত্বও বাতিল করার চেষ্টা করছেন৷ আমার অপরাধ কী?
করাচিতে কিছুদিন আগে আমার জীবননাশের চেষ্টা হয়েছে৷ আমার শরীরে লেগেছে ছয়টি গুলি৷ জিয়ো টিভিতে আমার পরিবারের সদস্যরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে৷ কারণ, সাম্প্রতিক অতীতে আমি আমার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম, কয়েকজন আইএসআই কর্মকর্তা চরমপন্থীদের ব্যবহার করে আমার টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা করছেন৷ আমার পরিবার যখন এই সন্দেহের কথা জানায়, তখন আমি হাসপাতালে অচেতন অবস্থায়৷ হামলার দ্বিতীয় দিন আমার জ্ঞান ফেরার পর আমি আমার পরিবারের অবস্থানের সঙ্গে সহমত পোষণ করি৷ সঙ্গে সঙ্গে আইএসআই সরকারের কাছে আবেদন করে, যাতে জিয়ো টিভিকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ কিছু নিষিদ্ধঘোষিত জিঙ্গ সংগঠনও এর সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসে, তাদের মধ্যে লস্কর-ই-তাইয়েবার (এলইটি) হাফিজ সাঈদও আছেন৷ তঁাদের দাবি, আমাকে ও আমার পরিবারকে যেন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ কিছু গোষ্ঠী অনেক দিন থেকেই আমাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করার চেষ্টা করছে৷ যঁারা স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা করে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন, তঁাদের বিশ্বাসঘাতক বলা হয়েছে৷ আবার গণতন্ত্রের স্তুতি করে কবিতা লেখাকে দেশদ্রোহী কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এই বন্দুকধারীরা পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহকেও এই অভিধা দিয়েছিল, যদিও তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন৷ সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান গণতন্ত্র নস্যাৎ করার চেষ্টা করলে ফাতেমা জিন্নাহ তার কড়া সমালোচনা করেছিলেন৷ তিনি ওই স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দঁাড়ালে তাঁকে ভারতীয় চর ও বিশ্বাসঘাতক বলা হয়েছে৷ কখনো আমাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে কবি হাবিব জালিবের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে৷ এই কবি ১৯৭১ সালে ঢাকায় সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে কবিতা লিখেছিলেন৷
জেনারেল ইয়াহিয়ার আমলে তঁাকে বিশ্বাসঘাতক উপাধি দিয়ে জেলে ঢোকানো হয়েছে, যে ইয়াহিয়ার নির্দেশে ঢাকায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তািন সেনা আত্মসমর্পণ করে৷ আমাকে পশতু জাতীয়তাবাদী নেতা ওয়ালি খানের মতো বিশ্বাসঘাতক বলা হয়েছে৷ এমনকি বেলুচের জাতীয়তাবাদী নেতা গাউস বক্স, আতাউল্লাহ প্রমুখ মানুষের সঙ্গেও আমার বিশ্বাসঘাতকতার তুলনা করা হয়েছে, যদিও এসব ব্যক্তি ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন এবং তার আলোকে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন৷ পরবর্তীকালে, আমাকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো বিশ্বাসঘাতক বলা হয়েছে, তিনি পাকিস্তানকে ১৯৭৩ সালের সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন৷ ভুট্টোর নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে তঁাকে ভারতীয় চর বলা হয়েছে৷ একটি খুনের মামলায় মিছামিছি জড়িয়ে তঁাকে গারদে ঢোকানো হয়৷ এটা ছিল জেনারেল জিয়াউল হকের সামরিক জামানা, ভারত এ সময় সিয়াচেনের ঊর্ধ্বাঞ্চল দখল করে নেয়৷ এই জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফঁাসিতে ঝুলিয়েছিলেন৷ এই আমলে অনেক রাজনীতিবিদ যেমন বেনজির ভুট্টো, মওলানা ফজলুর রেহমান, কবিদের মধ্যে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, আহমেদ ফরাজ এবং আমার বাবা ওয়ারিস মির ও অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক ও লেখককে বিশ্বাসঘাতক উপাধি দেওয়া হয়েছে৷ বিদেশিদের স্বার্থে করা যুদ্ধকে জিয়াউল হক ‘দেশাত্মবোধক’ আখ্যা দিয়েছেন৷ তিনি পাকিস্তানে কালাশনিকভের সংস্কৃতি চালু করেন৷ একই সঙ্গে গোষ্ঠীগত, ভাষাগত ও বর্ণগত বিভাজন ও সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার সংস্কৃতি শুরু হয় তঁার আমলেই৷ জিয়াউল হক তঁার বিরুদ্ধে

No comments

Powered by Blogger.