মানবাধিকারের প্রশ্নটি উপেক্ষণীয় নয় by আলী ইমাম মজুমদার

বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিশেষ করে র‌্যাব কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বেশ কিছু অভিযোগ সময়ে সময়ে এসে থাকে। এমনকি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে অপরাধজগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার। এ ধরনের অভিযোগে নাগরিক সমাজ ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। তারা চায় এমনটা না ঘটুক। তারা আরও চায়, আইন প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই হোক দক্ষ, কর্মতৎপর আর জনপ্রত্যাশার প্রতি সংবেদনশীল। জনগণ এ আশাও সংগত কারণে করে যে তারা হবে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্রটাই দেখা যাচ্ছে অধিক পরিমাণে। আর তা ক্রমবর্ধমান হারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নাগরিক ভাবনা ও নাগরিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দঁাড়িয়েছে।
এ ধরিত্রীতে আমরা একটি ছোট দেশ বটে। দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা আর রোগ-ব্যাধির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছে এ দেশের মানুষ। স্বাধীনতার পর এই দীর্ঘ সময়ে সাফল্যও এসেছে উল্লেখ করার মতো। তবে নানাবিধ কারণে আমাদের অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। আর এক দেশ অন্য দেশের সঙ্গে এ ধরনের নির্ভরশীলতা থেকেই থাকে। তবে তুলনামূলকভাবে দরিদ্রদের প্রয়োজন তা বেশি। তাই এ ধরনের দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়েও আজ অন্যরা কথা বলে। এমনকি কথা বলে অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও। তারা নানাবিধ পরামর্শ দেয়। তবে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ইদানীং জোর দেওয়া হচ্ছে। ফলে এ ধরনের পরামর্শ নির্বিচারে গ্রহণ করার প্রয়োজন না থাকলেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। তারা সম্প্রতি পরামর্শ দিয়েছে, র‌্যাব ভেঙে দিয়ে নতুন একটি বেসামরিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। সে সংগঠনটি মানবাধিকারকে মূল ভিত্তি ধরে সংঘবদ্ধ অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেবে। প্রস্তাবিত এ সংগঠনটিতে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের না নিতেও পরামর্শ দিয়েছে তারা। চলমান পরিপ্রেক্ষিতে এ সংস্থার পরামর্শ ভেবে দেখার বিষয়। তবে প্রতিষ্ঠানটির সূচনা আর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও একই সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।
র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পটভূমিকায় দেখা যায়, ২০০২ সালের দিকে একদল জঘন্য অপরাধী অন্তত তখনকার মতো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে উঠেছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অনেকটা অসহায় মনে হচ্ছিল তাদের মোকাবিলায়। সে ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামের অভিযানটির সাফল্য থেকে শিক্ষা ও প্রেরণা নিয়ে ২০০৪ সালে সরকার পুলিশের একটি অঙ্গরূপে র‌্যাব গঠন করে। তবে
এর কাঠামোয় যুক্ত হয় পুলিশের পাশাপাশি সামরিক বাহিনী, বিজিবি ও আনসার। সার্বিক নিয়ন্ত্রণ থাকে আইজিপির হাতেই। তবে অপারেশনাল দায়িত্বের নেতৃত্ব অনেকাংশে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ওপর ন্যস্ত। সেই র‌্যাব বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য নন্দিত ও নিন্দিত হচ্ছে সময়ে সময়ে। এর কাঠামোগত দিক কিছুটা জটিল। তবে সুনিয়ন্ত্রিত একটি কমান্ড স্ট্রাকচারে চলছে বাহিনীটি।
এর অসাধারণ সাফল্য জেএমবির মতো একটি জঙ্গি সংগঠনের কাঠামো ভেঙে দিয়ে মূল নেতাদের গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় আনা। উল্লেখ করতে হয়, র‌্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ এন্তার। কিন্তু প্রশংসার সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, জেএমবির জঙ্গি নেতৃত্বকে র‌্যাব আইনের আওতায় এনেই বিচারের মুখোমুখি দঁাড় করিয়েছিল। বাংলা ভাই নামের জিঙ্গনেতাকে গ্রেপ্তারে রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু জীবন্ত গ্রেপ্তার করা হয় তঁাকে। যে তিন জঙ্গিকে সম্প্রতি গাজীপুর-ময়মনসিংহ সড়কে প্রিজন ভ্যানে হামলা ও পুলিশের এক সদস্যকে হত্যা করে তাদের সঙ্গীরা তখনকার মতো মুক্ত করে, তারা এই র‌্যাবের দ্বারাই গ্রেপ্তার। বিচারবহির্ভূত কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই যদি জেএমবির মতো সংগঠনকে অন্তত দীর্ঘ সময়ের জন্য নিষ্ক্রিয় করা যায়, তবে অন্য ক্ষেত্রে তা হবে না কেন? খুব বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিচারবহির্ভূত কার্যক্রমের সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষ পরিচিত ছিল না। কিন্তু ২০০২ সালের দিকেই এটা একধরনের সামনে চলে আসে এবং প্রসারও ঘটে। পরিস্থিতির রাশ টেনে ধরার কোনো দৃঢ় ইচ্ছা সরকারগুলোর দেখা যায়নি।
শুরুতে শুধু র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। এখন পুলিশের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ আসছে সমান তালে। তাহলে র‌্যাব ভেঙে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে, এমনটি বলা যায় না। আবশ্যক রয়েছে আইনের সুষ্ঠু ও যথাযথ প্রয়োগ। এ ধরনের সব অভিযোগ আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
এখানে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিষয়ে কিছু আলোচনার আবশ্যকতা রয়েছে। সংস্থাটি নিউইয়র্কভিত্তিক এবং মানবাধিকার নিয়ে গবেষণা ও মতামত দেয়। সংগঠনটির লক্ষ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে বিশ্বসমাজে চিহ্নিত করা। পাশাপাশি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর লক্ষ্যে সম্ভব হলে সেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলোচনা। ১৯৭৮ সালে ভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠানটির সূচনা মূলত তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্দেশ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া এবং পূর্ব ইউরোপের রাজনৈতিক রূপান্তরের পর নতুন নামে ১৯৮৮ সাল থেকে বিশ্বজনীন মানবাধিকার-সংক্রান্ত বেসরকারি সংগঠনের ভূমিকায় কাজ করছে তারা। এ সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে এরা মূলত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে অনুসরণ করেই কার্যক্রম পরিচালনা করে। গুয়ানতানামো বেতে অন্তরীণ আফগান যুদ্ধবন্দীদের প্রতি অমানবিক আচরণ তাদের কাছে আকাঙ্ক্ষিত অগ্রাধিকার পায়নি। তেমনি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রতিবেদনেও সংস্থাটি পক্ষপাতদুষ্ট বলে অনেকে অভিযোগ করেন। এগুলো যা-ই হোক, এখন সংস্থাটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য আর আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারও তা-ই। তদুপরি সংবিধানের নির্দেশনায়ও একই বিধান রয়েছে।
আজ র‌্যাব ভেঙে দেওয়ার দাবি যখন করা হচ্ছে, তখন নিকট অতীতে তাদের সাফল্যগুলো আলোচনায় সামনে আসছে না। র‌্যাবের কাঠামোয় বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয় রয়েছে। এ সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী দাবিও আছে। বারবার বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটির সাংগঠনিক কাঠামো পর্যালোচনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে র‌্যাব তার দায়িত্ব পালন করে সম্পূর্ণ নিজস্ব সাংগঠনিক কাঠামোয়। এখানে পুলিশের সঙ্গে তাদের উল্লেখ করার মতো কোনো সমন্বয় লক্ষণীয় হয় না। জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাধারণ তত্ত্বাবধানে পুলিশ সুপার। সেই পুলিশ সুপার র‌্যাবের কার্যক্রম সম্পর্কে একরূপ অন্ধকারেই থাকেন। অর্থাৎ সংস্থাটি সমান্তরালভাবে কাজ করে চলছে। মাঠপর্যায়ে কোনো সমন্বয়ের আইনি সুযোগ রাখা হয়নি। এ সম্পর্কে একটি আনুষ্ঠানিক কাঠামো থাকার আবশ্যকতা উপেক্ষা করা যায় না।
তারপর আসছে এর কার্যক্রমে বিভিন্ন বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে। আইন অনুযায়ী র‌্যাব পুলিশের একটি ইউনিট। সামরিক বাহিনীকে বাদ দিয়েই যদি কাজগুলো হতো, তবে এটা গঠনের আবশ্যকতা থাকত না। পুলিশে সব পর্যায়েই বহু ভালো ভালো দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তা রয়েছেন। তঁারা অনেক ক্ষেত্রেই র্যাবে যেতে বা থাকতে চান না বলে বলা হয়ে থাকে। হয়তো বা কিছু প্রতিবন্ধকতা এ নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সে পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে ক্রমান্বয়ে পুলিশের অধিকসংখ্যক সদস্যের সমন্বয়ে এ সংস্থাটি
কাজ চালাতে পারে। সামরিক বাহিনীকে এ কার্যকর ও চৌকস বাহিনী থেকে নির্ভরযোগ্য বিকল্প ব্যতীত বাদ দেওয়া হলে প্রচণ্ড
একটি শূন্যতা সৃষ্টি হবে। জঙ্গি দমন, গুরুতর অপরাধ নিয়ন্ত্রণসহ সব ক্ষেত্রেই পড়বে এর নেতিবাচক প্রভাব।
এক দশকে প্রতিষ্ঠানটির যে অর্জন, তা বৃথা হয়ে যাবে। ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে আইন প্রয়োগ করলেও ফল লাভ হয়। অসহিষ্ণুতা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে উসকে দেয়। এ ধরনের অসহিষ্ণুতার অভিযোগে আমরা দেশে-বিদেশে নিন্দিত হচ্ছি। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রায়ই সমালোচনা করছে এসব ঘটনার। তাদের বক্তব্যকে অব্যাহতভাবে উপেক্ষা করা আমাদের জন্য কল্যাণকর নয়। এ সত্যটি মেনে নিতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে। তবে যে যা-ই বলুক, মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার আত্মঘাতী পথে আমরা পা বাড়াতে পারি না। উপযুক্ত ওষুধের মাধ্যমে সে ব্যথার উপশম ঘটাতে হবে। র্যাব প্রশ্নেও আমাদের থাকতে হবে এ ধরনের ভূমিকাই |

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.