ভারতে ঐতিহ্যের রাজনীতির অবসান?

সাম্প্রতিক কয়েকটি মাস ধরে বিশ্বের নানা প্রােন্ত চলছে উৎসব—গণতন্ত্রের উৎসব। নির্বাচনের উৎসব। নির্বাচন হয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক, আলজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতে। ইউরোপজুড়েও আগামী সপ্তাহে একটি (ইউরোপীয় পার্লামেন্ট) নির্বাচনের কথা রয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ও ইরাকের কথা একেবারেই আলাদা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক উৎসবটি হয়ে গেল ভারতে। সাড়ে ৮২ কোটি ভোটারের উৎসব। নির্বাচিত হলেন প্রায় সোয়া শ কোটি মানুষের নতুন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিবেশীর এই আনন্দে স্বভাবতই বাংলাদেশিদের উৎফুল্ল হওয়ার কথা। কিন্তু, অনেকেই সেখানে কিছুটা বিষাদের ছায়া দেখছেন। কারণ, তাঁরা তাঁদের ভোটের উৎসবটি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁদের ধারণা, ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন প্রহসন মঞ্চায়নের অন্যতম প্রধান কারণ ওই বৃহৎ প্রতিবেশীর সমর্থন। সারা বিশ্বের অন্য কেউ সমর্থন না করলেও তাঁরা ওই একতরফা নির্বাচনকে সমর্থন করেছেন। এঁদের বিশ্বাস, ওই সমর্থনটুকু না পেলে একতরফা নির্বাচন থেকে পিছিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হতেন। সুতরাং, নয় সপ্তাহ ধরে ভারতবাসীর ভোট দেওয়ার উৎসব দেখে ছোট প্রতিবেশীর ভোটবঞ্চিত অনেক নাগরিকের কিছুটা মর্মপীড়া হতেই পারে। ভারতের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের অবশ্য অন্য একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর তা হলো দেশটির স্বাধীনতার পর এই প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্য ও কৃতিত্বের রাজনৈতিক পুঁজি ভোটের বাজারে এবার আর কাজ করেনি। ব্রিটিশ উপনিবেশের নিগড় থেকে ভারতের মুক্তিলাভের আন্দোলনে মূল নেতৃত্ব ও কৃতিত্বের দাবিদার যে রাজনৈতিক দল, সেটি হচ্ছে কংগ্রেস এবং তার নেতৃত্বে থাকা নেহরু পরিবার। নেহরু পরিবার এবং কংগ্রেস গত ৬৭ বছরে নানা ধরনের সাময়িক বিপর্যয় বা বিপত্তির মুখে পড়লেও তার বিকল্প হিসেবে কোনো সর্বভারতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থান এর আগে ঘটেনি।
বিশাল এই দেশটির বিভিন্ন প্রােন্ত নানা ধরনের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক সাফল্য অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের সর্বভারতীয় বিকল্প গড়ে ওঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টি, বিজেপি এর আগে একাধিকবার ক্ষমতায় এলেও দেশটির বেশ কয়েকটি অঞ্চলে তাদের অবস্থান ছিল একেবারে দুর্বল অথবা শূন্য। কিন্তু, এবার সর্বভারতীয় পটভূমিতে তাদের যে নাটকীয় সাফল্য ও উত্থান, তার মধ্য দিয়ে দেশটির রাজনীতিতে কংগ্রেসের একচেটিয়া আধিপত্যের যে অবসান ঘটল, তাতে সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই। বিজেপির এই বিজয়ের নায়ক যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারক, কর্মঠ এবং উন্নয়নমুখী রাজনীতিক নরেন্দ্র মোদি, তাতে সন্দেহ নেই। ‘গুজরাটের কসাই’ খেতাব সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদি ভারতের কোটি কোটি ভোটারকে উন্নয়ন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখিয়েছেন। চা-ওয়ালা থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো বড় হওয়ার স্বপ্ন। ফলে, ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি একটি নতুন ভারতের স্বপ্নে ভারতবাসীকে উজ্জীবিত করায় সফল হয়েছেন মি. মোদি এবং তাঁর দল বিজেপি। ভারতের রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদির বিজয় যে রূপান্তরের (ইংরেজিতে মোডিফিকেশন) সূচনা করেছে তাকে অনেকে ‘ভারতের মোদিফিকেশন’ বলেই অভিহিত করছেন। মোদিমত্ত ভারতে সাত দশক আগের স্বাধীনতার কৃতিত্ব ও উত্তরাধিকারের রাজনীতি এবার আর হালে পানি পায়নি। এমনকি, আসনসংখ্যা (১০ শতাংশেরও নিচে) এতই কম যে এককভাবে কংগ্রেসের সংসদীয় বিরোধী দলের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়াটাই তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তার কারণ, দুর্নীতি (জামাই রবার্ট ভদ্রের শতকোটিপতি হওয়ার অভিযোগ), অপশাসন, আত্মম্ভরিতা ও জনবিচ্ছিন্নতা। জোটের ছোট শিরক ও আঞ্চলিক দলগুলোর চাপের কাছে জিম্মি হওয়ার কারণে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনব্যবস্থা ছিল দুর্বল (যেটা বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ব্যর্থতাতেও দৃশ্যমান)।
নেপথ্য থেকে নেহরু পরিবারের নির্দেশনায় পরিচালিত সরকারের সব ব্যর্থতার দায় তাই শেষ পর্যন্ত বর্তেছে স্বল্প ও মৃদুভাষী সজ্জন ব্যক্তি মনমোহন সিংয়ের ঘাড়ে। ভারতের রাজনীতিতে এই অভাবনীয় পরিবর্তনের এক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় গার্ডিয়ান পত্রিকার সাম্প্রতিক এক সম্পাদকীয়তে (৫ মে ২০১৪)। এতে বলা হয়েছে, উপনিবেশের নিগড় থেকে মুক্তি পাওয়া কোনো দেশে প্রকৃত অর্থেই যদি রাজনীতি প্রত্যাশা করতে হয়, তাহলে প্রয়োজন ‘স্বাধীনতা’ থেকে মুক্তি অর্থাৎ স্বাধীনতার রাজনীতি থেকে মুক্তি। স্বাধীনতার রাজনীতির এই জটিল সমীকরণ ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যগুলো থেকে স্বাধীনতা লাভের পর বিশ্বের নানা প্রােন্ত বিভিন্ন দেশেই এটি পরিলক্ষিত হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে যে দলের জন্ম অথবা উত্থান ঘটেছে, সেই দলটিই সে দেশে স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতিতে প্রাধান্য বজায় রেখেছে। সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে এটা যেমন স্বাভাবিক তেমনি অস্বাভাবিক। স্বাভাবিক, কেননা, যাঁরা দেশটির স্বাধীনতার জন্য লড়াই ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁদের প্রতি সবাই কৃতজ্ঞবোধ করে এবং তাঁরা শ্রদ্ধা অর্জন করেন। ফলে, রাজনীতিতে নতুন কারও আবির্ভাবের বিপরীতে তাঁরা কিছুটা বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে, এই উত্তরাধিকারের অস্বাভাবিকতা হচ্ছে এই যে রাজনীতিতে নতুন শক্তির উত্থান কঠিন হয়ে পড়ে এবং তাদের অধিকতর প্রতিকূলতা মোকািবলা করতে হয়। দলভিত্তিক রাজনীতিতে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা কঠিন হয়ে পড়ে। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়,
ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের দল কংগ্রেসের এই একচ্ছত্র প্রভাব দূর হতে কেটে গেছে কয়েক দশক। পত্রিকাটি বলছে, দক্ষিণ আফ্রিকা বা আলজেরিয়ায় সে রকম সম্ভাবনা এখনো সুদূরপরাহত। ব্যাপক দুর্নীতি, অব্যাহত দারিদ্র্যের চাপ, বেকারত্ব সত্ত্বেও সেখানে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) আবারও নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এবং দল যদি বিকল্প বিবেচনা না করে, তাহলে দুর্নীতির অভিযোগ ও অপশাসনের জন্য বহুল সমালোচিত জ্যাকব জুমা প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হবেন বলেই সবার ধারণা। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির একটি বড় অভিযোগ হচ্ছে, নিরাপত্তা বাড়ানোর অজুহাতে নিজের ব্যক্তিগত বাসভবনের উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দুই কোটি ৩০ লাখ ডলার ব্যয়। আলজেরিয়ায় সে রকম কোনো দল না থাকলেও স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী কতিপয় সেনাপতির শিখণ্ডী নিষ্ঠুরতার জন্য নিন্দিত এবং অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট আবদেল আজিজ বুথেফ্লিকা। ৫০ বছর ধরে দেশটিতে যা চলছে, তা গণতন্ত্রের নামে মশকরা বা সাজানো নাটক। গার্ডিয়ান তার সম্পাদকীয়তে বলেছে যে এসব দেশের গতিপথ যা তুলে ধরেছে তা হলো, যেসব জাতি স্বাধীনতার পূজা করছে, তারা তা করছে তাদের দুর্ভোগের বিনিময়ে। আর, তাই প্রকৃত রাজনীতির উত্থানের জন্য প্রয়োজন ‘স্বাধীনতা’ থেকে স্বাধীনতা। পত্রিকাটির এই বিশ্লেষণ বাস্তবে আরও অনেক দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
দুই. হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সমুন্নত রাখার অঙ্গীকারের ভবিষ্যৎ এখন কী, সেই প্রশ্ন এখন অনেকটাই অবান্তর। বরং, এখনকার প্রধান দুশ্চিন্তা, সাম্প্রদায়িকতার এই বিষবাষ্প ভারতের বাইরে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় কতটা দূষণ ঘটাবে, সেই শঙ্কা। এই উদ্বেগের মূলে রয়েছে প্রতিবেশীদের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব, যার সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। দেশটিতে ইসলামপন্থী রাজনীতির উত্থানের আশঙ্কায় ভারতের নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগ এতটাই তীব্র ছিল যে প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খোলামেলা হস্তক্ষেপের দৃষ্টান্ত স্থাপনেও তাঁরা পিছপা হননি। জাতীয় পার্টির প্রধান জেনারেল এরশাদের সঙ্গে বৈঠকে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের খোলামেলা মন্তব্য ছিল রীতিমতো এক বিস্ময়। মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণটি খুব সোজা। কেননা, নরেন্দ্র মোদি যেমন বাজপেিয় নন, তেমনি মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপিও সেই বিজেপি নয়। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও মুসলিম নিধনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারায় বাজপেিয় ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রাজধর্মের (শাসকের ধর্ম) রীতি মেনে সব নাগরিকের প্রতি সমতার নীতি অনুসরণে মুখ্যমন্ত্রী ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি এমনকি মি. মোদিকে দল থেকে বহিষ্কার না করলে নিজে দল থেকে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন৷

No comments

Powered by Blogger.