অধিকৃত নগর, প্রতিরোধের সাহিত্য

ঢাকা যে একটি অবরুদ্ধ নগরী, যেখানে ঘরে-বাইরে প্রতিপদে আতংক আর মৃত্যুভয় এবং শহরটি পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক অধিকৃত - নগরবাসী এ নির্মম সত্যটি বুঝতে শুরু করে ১৯৭১-এর এপ্রিল-মে থেকে। পঁচিশে মার্চের নির্বিচার গণহত্যার দুঃস্বপ্ন তখনও মানুষকে তাড়া করে ফিরছে - ওই ভয়াল স্মৃতি ভোলার মতো নয়, কিন্তু ঢাকার নগরজীবনকে পৃথিবীর মানুষের কাছে স্বাভাবিক দেখানোর জন্য সামরিক জান্তা তখন মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
শহরের দোকানপাট খুলে গেছে, বাজারে মোটামুটি ভিড়, হাতেগোনা হলেও স্কুল-কলেজে যাচ্ছিল ছাত্রছাত্রীরা। সিনেমা হলও খুলতে শুরু করেছে। কিন্তু পঁচিশে মার্চের কালরাত্রি বাঙালির মনে যে-গভীর ক্ষত তৈরি করে গেছে, তা শুকোচ্ছিল না।
ঢাকার বাহ্যিক জীবন তখন যে কোনো বড় নগরীর মতো, তবে ওতে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণচাঞ্চল্য ছিল না। রাস্তায় যানবাহন ও লোক চলাচল নেমে গিয়েছিল অর্ধেকেরও নিচে, শহরের মোড়ে মোড়ে আর্মি চেকপোস্ট, বড় সড়কে সেনাবাহিনীর টহল, মানুষ হাঁটে প্রায় নিঃশব্দে এবং দ্রুত। অবরুদ্ধ ঢাকার তথাকথিত স্বাভাবিকতায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল হিম-শীতল আতংক, যাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের সাদা ভয়। সব ছাপিয়ে ছিল মৃত্যুভয়।
জুনের মধ্যে ঢাকার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ চলে গেছে পল্লী এলাকায় বা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ওসব এলাকা তখনও মুক্ত এবং ঢাকার চেয়ে নিরাপদ। অন্যদিকে বহু আক্রান্ত মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থী শিবিরে। বাস্তুভিটাচ্যুত বাঙালির দুর্ভোগ তখন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রধান খবর।
অধিকৃত ঢাকা আক্ষরিক অর্থে আতংকের নগরী হয়ে ওঠে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর। এর পরপরই ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে পুরোমাত্রায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর তরুণ যোদ্ধারা অল্পদিনের মধ্যে তাদের অপারেশন শুরু করে দেশের গ্রামাঞ্চলে, শহরতলীতে, ঢাকার উপকণ্ঠে। এক সময় মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পাওয়া যেতে থাকে খোদ মহানগরীতেও। বেশিদিন লাগেনি, পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগুপ্তা হামলা এক সময় হয়ে ওঠে নিত্যদিনের ব্যাপার। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের পর ঢাকা এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ দেখতে থাকে পাকবাহিনীর সঙ্গে, রাজাকার এবং আলবদর-আল শামস বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি লড়াই। এ সময় পাকবাহিনী হিংস্র হয়ে ওঠে। বেড়ে যায় তাদের নির্যাতন, এবং পাড়ায়-মহল্লায় ধরপাকড় ও তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলার মত ঘটনা।
১৯৭১-এর অবরুদ্ধ ঢাকা বিভিন্ন যুদ্ধে-মহাযুদ্ধে শত্র“ কর্তৃক অধিকৃত পৃথিবীর অন্যান্য নগরী থেকে পৃথক ছিল না কোনোভাবেই। ওইসব শহরে বন্দি বা প্রতিরোধ-লড়াইয়ে অংশ নেয়া লেখকদের রচনায় অবরুদ্ধ সময়ের যে-চিত্র পাই আমরা, বাংলাদেশের কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদের লেখাতেও আমরা একই আর্তি-বেদনা, দেশপ্রেম এবং মাতৃভূমিকে মুক্ত করার অঙ্গীকার লক্ষ্য করি। অধিকৃত শহরের শিল্পী-লেখকদের প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই আমাদের মনে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নাৎসি বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ প্যারিসের রেজিস্ট্যান্ট মুভমেন্ট এবং এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কবি, ঔপন্যাসিক এবং চিত্রশিল্পীদের কথা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কবি পল এলুয়ার এবং রেনে শার। আতংকের এই নগরীতে জার্মান দখলদার বাহিনী যখন তাদের নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছিল, প্যারিসের আন্ডারগ্রাউন্ড, অর্থাৎ গুপ্ত পত্রপত্রিকার মুদ্রণের ভেতর দিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন সেখানকার লেখক সমাজ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলবের কামু।
প্যারিসের মতো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্রিটেনের লন্ডনও নাৎসি বিমানবাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমণের ফলে এক বিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পূর্ব লন্ডন হয়ে দাঁড়ায় ধ্বংসস্তূপ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে প্রতিরোধ এবং শান্তির স্বপক্ষের কবিতা নিয়ে ইংরেজিভাষী এবং অন্যান্য দেশের পাঠকদের উজ্জীবিত করেছিলেন ব্রিটিশ ওয়ার পোয়েট্রি আন্দোলনের কবিরা। মূলত পঁচিশ সদস্যের এই কবিগোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন উইলফ্রেড ওয়েন। ইংরেজি কবিতায় এ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা এবং বিপর্যয়ের পটভূমিতে আন্তর্জাতিক কবিতায় আবির্ভূত হলেন অডেন, স্টিফেন স্পেন্ডার, ডে-লুইস প্রমুখ ব্রিটিশ কবিরা। এদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন আমেরিকার কবিরাও। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে আসে জেমস ডিকি এবং এলিজাবেথ বিশপের নাম।
১৯৩৬-১৯৩৯-এর স্পেনের গৃহযুদ্ধ থেকে উঠে আসেন গার্সিয়া লোরকা,আন্তোনিও মাচাদো, রাফায়েল আলবের্তি প্রমুখ কবিরা। স্বৈরাচারী শাসক ফ্রাঙ্কোর মাদ্রিদ দখলের ফলে এদের প্রায় সবাইকে রাজধানী ছাড়তে হয়। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের বর্বরতা ও বিভীষিকা এবং মানবজাতির শান্তির আকাক্সক্ষাকে অমর করে রেখেছেন দেশটির অমর শিল্পী পাবলো পিকাসো তার চিত্রকর্ম গুয়ের্নিকায়।
বিশ শতকে যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং আতংকগ্রস্ত নগরীর তালিকায় আরও শহরের নাম এসে যায়। কে অস্বীকার করবে, আধুনিক ইতিহাসের কলংক হয়ে আছে হিটলারের বার্লিন এবং এর ইহুদি নিধনযজ্ঞ, দখলকৃত পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারস এবং এর ওপর নাৎসি বাহিনীর নির্যাতন? নাৎসি বাহিনীর বর্বরতা এবং হিটলার অধিকৃত জার্মানি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনেক কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। আধুনিক চলচ্চিত্রের এক প্রধান বিষয়বস্তু জার্মানি এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। ডেভিড লীন এবং, সাম্প্রতিককালে, স্টিফেন স্পিলবার্গের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয়। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনবদ্য কিছু চলচ্চিত্র।
এ মুহূর্তে মনে আসছে নাৎসি বাহিনী কর্তৃক লেনিনগ্রাড দখল নিয়ে ওই সময়ের সোভিয়েত কবি আনা আখমাতোভার স্মৃতিচারণমূলক রচনাটির কথা। একই সঙ্গে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, রচিত হয়েছে রক্তাক্ত বৈরুতের কবি মাহমুদ দারবিশের অসংখ্য কবিতা। ডাচ কিশোরী অ্যান ফ্রাংকের মর্মস্পর্শী ডায়েরি এখন সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়।
যুদ্ধকালীন ডায়েরির প্রসঙ্গে আমরা বাঙালিরা অনিবার্যভাবে উল্লেখ করি একটি রচনার কথা : জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি। মুক্তিযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ ঢাকার অবস্থার ওপর এ এক অমূল্য দলিল। ওই সময়ের ঢাকার প্রায় প্রতিদিনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে এ বইয়ে।
নমাসব্যাপী অবরুদ্ধ ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যকর্মের ভেতর বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় শামসুর রাহমানের কবিতা। ওই বৈরী এবং বীরত্বদীপ্ত সময় নিয়ে বেশ কিছু কবিতা রচনা করেছেন কবি, যেগুলোর অনেকগুলো পড়ি আমরা তার বন্দি শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থে। একটি কবিতায় কবি লেখেন, ”কবুরে স্তব্ধতা নিয়ে বসে আছি। নড়ি না চড়ি না/ একটুকু, এমনকি দেয়ালবিহারী টিকটিকি/ চকিতে উঠলে ডেকে, তাকেও থামিয়ে দিতে চাই... সমস্ত শহরে/ সৈন্যরা টহল দিচ্ছে, যথেচ্ছ করছে গুলি, দাগছে কামান/ এবং চালাচ্ছে ট্যাংক যত্রতত্র। মরছে মানুষ/ পথে-ঘাটে-ঘরে, যেন প্লেগবিদ্ধ রক্তাক্ত ইঁদুর।” [পথের কুকুর]
সিকদার আমিনুল হকের একটি কবিতায় মোটামুটি একই চিত্র পাই আমরা। তিনি লেখেন : পেছনের বারান্দায় একা, চুপচাপ বসে থাকি।/ এখন বন্ধুরা নেই, আড্ডা নেই, নিউমার্কেটের/ গুলতানি, ভালো বই নিয়ে তর্ক, সব চুকেবুকে গেছে;/... গ্রেনেডে জানানি দেয়, যেই রাত্রি নামে, মনে মনে/ বলি দীর্ঘজীবী হও! তখনই ইতর শব্দ করে/ মিলিটারি জিপ যায়... [প্রাণী ও মানুষ]
একাত্তরের অবরুদ্ধ ঢাকার ওপর গল্প, উপন্যাসও রচিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। ওই ভয়ানক সময়ে শেষ-সকালে বাড়ির সামনের রাস্তায় এক অচেনা তরুণের লাশ পড়ে থাকতে দেখার পর মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের মানসিক অবস্থা ও আচরণের বাস্তবানুগ বর্ণনা দিয়েছেন মাহমুদুল হক। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কোনো কোনো লেখায় সময়টি উঠে এসেছে। শওকত আলী, মঞ্জু সরকার, রাবেয়া খাতুন, তাপস মজুমদার প্রমুখ অধিকৃত নগরীর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থাকে ধরেছেন তাদের গদ্যরচনায়। অন্যদিকে, নাসির উদ্দিন ইউসুফের চলচ্চিত্র গেরিলা দেখতে দেখতে মনে হয়, আমি ফিরে গেছি একাত্তরের ঢাকায়। কী জীবন্ত এর ভাষা! তবে একাত্তরের ঢাকার সবচেয়ে বিশদ চিত্র পাই আমরা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ও গল্পে। অবরুদ্ধ নগরী এবং এর অসহায় অধিবাসীদের এমন আন্তরিক বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। যে কথাটি না বললেই নয়, নগরী বা জনপদ অধিকৃত হতেই থাকবে মানুষের মূঢ়তার কারণে, এবং থেমে থাকবে না ওসব জায়গার লেখক-শিল্পীদের প্রতিবাদী সৃজনশীলতাও। হ (পুনশ্চ: কিছু সময় ছাড়া এই রচনার লেখক অধিকৃত ঢাকায় ছিলেন।)

No comments

Powered by Blogger.